পাতা:বিশ্বকোষ ঊনবিংশ খণ্ড.djvu/৩৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বঙ্গদেশ (ভূতত্ত্ব)
[৩৯৩]
বঙ্গদেশ (ভূতত্ত্ব)

কৌশিকী তীর্থের কিছু দূরে পঞ্চশত নদীযুক্ত গঙ্গাসাগরসঙ্গম এবং তথা হইতে কিছু দূরে সাগরতীরে কলিঙ্গদেশ থাকায় বেশ বুঝা যায় যে, সমগ্র তীর তৎকালে উত্তররাঢ়ের কিয়দ্দূর পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কৌশিকীর বর্ত্তমান নাম কুশী। তারকেশ্বরের নিকটবর্ত্তী হরিপাল প্রভৃতি গ্রামের নিকট কৌশিকীর প্রাচীন গর্ভ দৃষ্ট হয়। গ্রীকরাজদূত মেগেস্থনিস পাটনার ৩০০ মাইল দূরে গঙ্গাসাগর-সঙ্গমের কথা লিখিয়া গিয়াছেন।[১] এই বিবরণগুলি যে প্রাগুক্ত ভূপঞ্জর গঠনের সমর্থক, তাহাতে আর কিছু মাত্র সন্দেহ নাই।

 আজকাল যেরূপ আমরা নোয়াখালি জেলার সমুদ্রোপকূলে সন্‌দ্বীপ প্রভৃতি চরজাত দ্বীপের উৎপত্তি দেখিতেছি, প্রাচীন কালেও সেইরূপ সমুদ্রতীরবর্ত্তী নদী সকলের মোহানার পলি পড়িয়া চর হইতে ক্রমে দ্বীপের উৎপত্তি ঘটিয়াছিল। এই কারণে অনেক স্থানের নাম-শেষে ‘দ্বীপ’ ‘দিয়া’ ও ‘চর’ শব্দ দৃষ্ট হয়। চন্দ্রদ্বীপ, নবদ্বীপ, অগ্রদ্বীপ, শুকচর, বকচর, কাঁটাদিয়া, রূপদিয়া প্রভৃতি স্থানগুলি সম্ভবতঃ ঐরূপেই পলিজ চর হইতে উদ্ভূত হইয়া থাকিবে।

 তৎকালীন লোকসমাজের প্রথিত চর কালে বৃক্ষলতাদিতে পরিপূর্ণ হইয়া উপবন, গ্রাম ও ক্রমে নগরে পরিণত হইয়াছে। কিন্তু আজিও সেই চরাভিধান অপসৃত হয় নাই। চক্রদহ, খড়দহ, শিবাদহ প্রভৃতি যেরূপ নদীগর্ভ হইতে কালে সৌধমালামণ্ডিত সুরম্য নগরে পর্য্যবসিত হইয়াছে, সেইরূপ নদীস্রোতে সমানীত বালুকণাও মোহানাস্থ সমুদ্রতটে সঞ্চিত হইয়া চরভূমির উৎপত্তি ঘটাইতেছে। আজ যেখানে মকরসংক্রান্তি দিনে সাগরতীর্থযাত্রিগণ সমবেত হইয়া স্নানাদি করেন, কিছুকাল পরে উহা সমুদ্রগর্ভ ভেদ করিয়া উপরে উঠিবে এবং ক্রমে গ্রামে নগরে পরিণত হইয়া যাইবে।

 মেঘনা নদীর সাগরসঙ্গম স্থলে বাদুরা, মানপুরা প্রভৃতি দ্বীপ যাহা ৭০ǀ৮০ বর্ষ পূর্ব্বে কেবল ভাঁটার সময় জাগিয়া উঠিত ও জোয়ারের সময় ডুবিয়া যাইত, যাহা তখন সম্পূর্ণ বাদার অবস্থায় পরিণত হয় নাই, এখন তাহাই উচ্চভূমি এবং বহুজনাকীর্ণ গ্রামসমূহে পরিপূর্ণ হইয়াছে। তাহার পর নাজীরচর, ফাল্‌কন্‌চর নামে আরও দুইটী ক্ষুদ্র দ্বীপ উল্লেখযোগ্য। খৃষ্টীয় ১৮৬০ সালেও উহা জঙ্গলপূর্ণ জলাজমি ছিল, এখন তথায় বহু লোকের বাসস্থান হইয়াছে। ঐরূপ আরওঁ দক্ষিণে এবং সমুদ্র মধ্যে রাবণাবাদ নামক কয়েকটী দ্বীপ, কুক্‌ড়িমুক্‌ড়ি চর, ধোপাচর প্রভৃতি আরও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কতকগুলি দ্বীপ গত ৬০ হইতে ৪০ বৎসর মধ্যে জল হইতে জাগিয়াছে ও তাহাতে
লোকের বাস হইয়াছে। তার পর ২৪ পরগণা, খুলনা ও বরিশালের অত্যন্ত দক্ষিণভাগে, যে সকল স্থানে শতবর্ষ পূর্ব্বে সমুদ্রতরঙ্গ বহিত, এখন সে সকল স্থানে অসংখ্য গ্রাম নগর বসিয়াছে। এখনও নিত্য নূতন উত্থিত ভূমি সকল লাটে বিভক্ত হইয়া কালেক্টরী হইতে বিলি হইয়া থাকে এবং নূতন জঙ্গল কাটাইয়া আবাদ ও গ্রামাদি প্রতিষ্ঠিত হয়।

 নদীস্রোতঃ-চালিত বালুকাকণা নদীগর্ভে সঞ্চিত হইয়া চরের উৎপত্তি ঘটায়, এ কথা সর্ব্ববাদিসম্মত। এই বঙ্গভূমিতে প্রবাহিত গঙ্গানদী কিরূপ বেগে কত পরিমাণ মৃত্তিকা নিত্য বহন করিয়া সমুদ্রমুখে ঢালিয়া দিতেছে, তাহা গণনা করিলে চমৎকৃত হইতে হয়।

 প্রায় অৰ্দ্ধ শতাব্দ গত হইল, কএকজন অভিজ্ঞ যুরোপীয় পণ্ডিত গাজীপুরে বসিয়া নানা উপায় প্রয়োগ দ্বারা স্থির করিয়াছিলেন, গঙ্গা প্রতি বৎসরে সাগরসঙ্গম স্থলে ১৭৩৮২৪০০০০ মণ মাটি বহন করিয়া ঢালিয়া দিতেছেন। কিন্তু গাজিপুরের দক্ষিণে স্বয়ং গঙ্গা ও তাহার শোণ, অজয় প্রভৃতি শাখা নদী, সুন্দরবনের মধ্যস্থিত দ্বিপঞ্চশত নদী এবং তাহার পর উত্তরপূর্ব্ব-কোণ হইতে আগত ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী প্রভৃতি নদী, এই হিসাবে আরও কত মাটি বাহিয়া আনিতেছে, তাহার ইয়ত্তা করা যায় না।

 উপরোক্ত মৃত্তিকাস্তরের গঠন ও পরিণতি বাঙ্গালার কোন কোন বিভাগে কিরূপ ভাবে সংসাধিত হইয়াছিল, নিম্নে বিভাগ নির্দ্দেশ সহকারে তাহার একটী সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদত্ত হইল:—

 প্রথম বিভাগ।—রাজমহলের পর্ব্বতশ্রেণী হইতে আরম্ভ করিয়া ভাগীরথীর উৎপত্তিস্থান ছাপঘাটী পর্য্যন্ত বড়গঙ্গার দক্ষিণে এবং ছাপঘাটী হইতে ভাগীরথীর পশ্চিমদ্বার বাহিয়া মেদিনীপুর পর্য্যন্ত, মোটামোটী প্রায় এক প্রকৃতির মাটি দেখা যায়। ভূতত্ত্ববিদের সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখিলে, তাহাতেও বিভাগ দৃষ্ট হয়; কিন্তু স্থূল দৃষ্টিতে উহা প্রায় একই প্রকার। ইহার সর্ব্বত্রই সমান কাঁকর ও পাথর পূর্ণ, অথবা পাহাড়িয়া কঠিন মাটি বিদ্যমান। বিন্ধ্য ও পূর্ব্বঘাট পর্ব্বতশ্রেণীর মাটির প্রকৃতির সহিত ইহার অনেক বিষয়ে প্রভেদ থাকিলেও বস্তুতঃ এক বিষয়ে উভয়ই সমান—কাঁকর ও পাথর পূর্ণ পাহাড়িয়া মাটি। যেখানে কাঁকর বা পাথর দেখিতে পাওয়া যায় না, (যেমন বৰ্দ্ধমান জেলার দক্ষিণ ও পশ্চিমাংশ এবং হুগলির পশ্চিমাংশ,) সেখানে মাটি এত কঠিন ষে তাহাকেও পাথরের অনুকৃতাবস্থা বলিয়া কল্পনা করা যাইতে পারে এবং তাহার প্রকৃতিও এরূপ যে, বাঙ্গালার আর কোথায়ও তদনুরূপ মাটি পাওয়া যায় না। এই ভূভাগের মাটি বহু যুগযুগান্তর হইতে নির্ম্মিত, সুতরাং সোজা কথায় ইহাকে পাকা মাটি বলা যাইতে পারে। ইহা নিশ্চিত যে, এক সময়ে সমুদ্র
  1. Magesthanes Fragments, vi.