পাতা:বিশ্বকোষ ঊনবিংশ খণ্ড.djvu/৪০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বঙ্গদেশ (পুরাবৃত্ত)
[৪০২]
বঙ্গদেশ (পুরাবৃত্ত)

অর্থাৎ দস্যুদিগের জনক বলিয়া ঘৃণিত এবং অথর্ব্বসংহিতায় অঙ্গ ও মগধবাসীর প্রতি অনার্য্যোচিত শ্লেষোক্তি দেখা যায়। ঐ সকল প্রমাণ হইতে মনে হইবে যে, বৈদিকযুগে বর্ত্তমান বেহার হইতে বাঙ্গলা পর্য্যন্ত ভূভাগে অনার্য্য বা আর্য্যেতর জাতির প্রভাব বিস্তৃত ছিল। অনার্য্যপ্রভাব হেতুই ঐ সকল স্থানে আর্য্যগণ বাস করা সুবিধাজনক বা নিরাপদ মনে করিতেন না। এমন কি, বৌধায়ন ধর্ম্মসূত্রে লিখিত আছে যে বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র প্রভৃতি দেশে বেড়াইতে আসিলেও ভ্রমণকারীকে পুনস্তোম বা সর্ব্বপৃষ্ঠা ইষ্টি করিতে হইত।

 মনুসংহিতা-রচনাকালে সম্ভবতঃ বঙ্গের নির্জ্জন বনমধ্যে দুই একজন আর্য্যঋষির আশ্রম গঠিত এবং সেই সঙ্গে ঐ সকল স্থান তীর্থ বলিয়া গণ্য হইয়াছিল। মনুসংহিতাকার তাই ব্যবস্থা করিয়া গিয়াছেন যে, তীর্থযাত্রা ব্যতীত অঙ্গ বঙ্গাদি দেশে কোন আর্য্যসন্তান যাইতে পারিবে না,—তীর্থযাত্রা ব্যতীত গমন করিলে দ্বিজাতিকে পুনঃ সংস্কার গ্রহণ করিতে হইবে।[১]

 ঐতরেয় ব্রাহ্মণে পুণ্ড্রগণ[২] বিশ্বামিত্রের সন্তান বলিয়া নির্দ্দিষ্ট[৩]। অথচ মনুসংহিতায় পৌণ্ড্রকগণের বৃষলত্ব বা শূদ্রত্ব প্রাপ্তির কথা আছে। (১০।৪৪) ইহাতে মনে হইবে যে যখন বিশ্বামিত্রের বংশধরগণ এদেশে আসিয়া বাস করেন, তখন এদেশে অপর আর্য্য ত্রৈবর্ণিকের বাস ছিল না, একারণ ব্রাহ্মণ অভাবে তাহদের সংস্কার লোপের সহিত তাঁহারা বৃষল ও এখানকার অনার্য্যজাতির সংস্রবে দস্যু বলিয়া চিহ্নিত হইয়াছিলেন।
[দস্যু ও বৃষল দেখ]

 কোন্ সময়ে বঙ্গদেশে আর্য্যসভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হইল, তাহা ঠিক জানিবার উপায় নাই। রামায়ণের সময়ে সূত্রপাত ও মহাভারতীয় যুগে আর্য্যসভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। রামায়ণে লিখিত আছে যে চন্দ্রবংশীয় অমূর্ত্তরজা নামে এক রাজা ধর্ম্মারণ্যের নিকট প্রাগ্‌জ্যোতিরপুর স্থাপন করেন।[৪] শতপথব্রাহ্মণ প্রভৃতি বৈদিক গ্রন্থ হইতেই প্রমাণিত হইয়াছে যে, বহু পূর্ব্বকালে মিথিলায় বিদেঘ মাথব কর্তৃক আর্য্যসভ্যতা বিস্তৃত হইয়াছিল।[৫] বর্ত্তমান জল্‌পাইগুড়ী রঙ্গপুর হইতে আসামের পূর্ব্বসীমা পর্য্যন্ত প্রাচীন ‘প্রাগ্‌জ্যোতিষ’ ——

  1. “অঙ্গবঙ্গকলিঙ্গেষু সৌরাষ্ট্রমগধেষু চ।
    তীর্থযাত্রাং বিনা গচ্ছন্ পুনঃসংস্কারমর্হতি॥” (মনু)
  2. মালদহজেলায় এখনও পুণ্ড্রগণের বাস আছে। [পুণ্ড্র দেখ]
  3. “এতেঽন্ধ্রা পুণ্ড্রাঃ শবরাঃ পুলিন্দা মৃতিবা ইত্যুদন্ত্যা
    বহবো ভবন্তি, বৈশ্বামিত্রা দস্যূনাং ভূয়িষ্ঠাঃ।” (৭।১৮)
  4. রামায়ণ ১।৩৫ সর্গ।
  5. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস ১ম ভাগ ৬০ পৃষ্ঠা।
দেশ বিস্তৃত ছিল, প্রাগ্‌জ্যোতিষপুর (বর্ত্তমান গৌহাটী) উক্ত প্রাগ্‌জ্যোতিষের রাজধানী। এখন কথা হইতেছে যে, মিথিলা (বর্ত্তমান দরভাঙ্গা) ও আসামে আর্য্যসভ্যতা বিস্তৃত হইল, অথচ মধ্যে অঙ্গ, বঙ্গ ও পৌণ্ড্রে আর্য্যোপনিবেশ স্থাপিত হয় নাই, তাহা কি কখন সম্ভবপর? মহাভারতে কর্ণপর্ব্বে (৪৫ অঃ) লিখিত আছে, “পৌণ্ড্র, কলিঙ্গ, মগধ ও চেদি দেশীয় মহাত্মারা সকলেই শাশ্বত পুরাতন ধর্ম্ম সবিশেষ অবগত আছেন এবং তদনুসারে কার্য্য করিয়া থাকেন”।[১] এই মহাভারতের উক্তি হইতে স্পষ্টই জানা যাইতেছে যে তৎপূর্ব্বেই পৌণ্ড্রে অর্থাৎ এখনকার উত্তর বঙ্গে বৈদিক ধর্ম্ম ও আর্য্যসভ্যতা প্রবেশ লাভ করিয়াছিল।

 হরিবংশ পাঠে অবগত হওয়া যায় যে, যযাতিপুত্র পুরুর অধস্তন ২২শ পুরুষে মহারাজ বলি জন্মগ্রহণ করেন। ইনি পরম যোগী ও নৃপতি ছিলেন। ইঁহার বংশধর পাঁচ পুত্র অঙ্গ, বঙ্গ, সুহ্ম, পুণ্ড্র ও কলিঙ্গ। ইঁহারাই মহারাজ বলির ক্ষত্রিয় সন্তান, কিন্তু তাঁহাদের বংশধর পুত্রগণ কালক্রমে ব্রাহ্মণত্ব লাভ করেন।[২]

 মহাভারতের আদিপর্ব্বে (১০৪ অধ্যায়) বর্ণিত হইয়াছে, “ভূলোক পরশুরাম কর্ত্তৃক নিঃক্ষত্রিয় হইলে অনেক ক্ষত্রিয়-পত্নী বেদপারগ ব্রাহ্মণদ্বারা সন্তান উৎপাদন করিয়া লইলেন। বেদের বিধান এই, যে পাণিগ্রহণ করে, তাহার ক্ষেত্রে যে সন্তান জন্মে, সেই সন্তান তাহারই হয়। অতএব ধর্ম্মাচরণ ভাবিয়াই ক্ষত্রিয়পত্নীগণ ব্রাহ্মণের সহবাস করিয়াছিল। এইরূপ ক্ষেত্রজ পুত্রের দৃষ্টান্ত দেখাইবার জন্য মহাভারতকার এই পুরাতন ইতিহাস কীর্ত্তন করিয়াছেন—

 ‘ক্ষত্রিয়রাজ বলির পুত্রসন্তান হয় নাই। তিনি একদিন গঙ্গাস্নান করিতে আসিয়া দেখিলেন, এক অন্ধঋষি নদীর স্রোতে ভাসিয়া আসিতেছেন। ধার্ম্মিক রাজা অবিলম্বে তাঁহাকে তুলিয়া নিজ প্রাসাদে আনিলেন। সেই অন্ধ ঋষির নাম দীর্ঘতমা। ধার্ম্মিক নরপতি তাঁহার ক্ষেত্রে পুত্রোৎপাদন করিবার জন্য ঋষিকে অনুরোধ করেন। তদনুসারে তাঁহার মহিষীর ——

  1. “কোশলাঃ কাশপৌণ্ড্রাশ্চ কালিঙ্গা মাগধাস্তথা
    চেদয়শ্চ মহাভাগা ধর্ম্মং জানন্তি শাশ্বতং।” (কর্ণপর্ব্ব ৪৫।১৪)
  2. “মহাযোগী স তু বলির্বভূব নৃপতিঃ পুরা॥
    পুত্রানুৎপাদয়ামাস পঞ্চবংশকরান্ ভুবি।
    অঙ্গঃ প্রথমতো জজ্ঞে বঙ্গঃ সুহ্মস্তথৈব চ॥
    পুণ্ড্র কলিঙ্গশ্চ তথা বালেয়ং ক্ষত্রমুচ্যতে।
    বালেয়া ব্রাহ্মণাশ্চৈব তস্য বংশকরা ভুবি।”
    (হরিবংশ ৩১৷৩৩-৩৫)