পাতা:বিষবৃক্ষ-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ - পিঞ্জরের পার্থী কুন্দ এখন পিঞ্জরের পাখী—“সতত চঞ্চল।” দুইটি ভিন্নদিগভিমুখগামিনী স্রোতস্বতী পরস্পরে প্রতিহত হইলে স্রোতোবেগে বাড়িয়াই উঠে । কুন্দের হৃদয়ে তাহাই হইল। এদিকে মহালজ্জা—অপমান—তিরস্কার—মুখ দেখাইবার উপায় নাই—স্বৰ্য্যমুখী ত বাড়ী হইতে দূর করিয়া দিয়াছেন। কিন্তু সেই লজ্জাম্রোতের উপরে প্রণয়স্রোত আসিয়৷ পড়িল । পরস্পর প্রতিঘাতে প্রণয়প্রবাহই বাড়িয়া উঠিল। বড় নদীতে ছোট নদী ডুবিয়া গেল। সূৰ্য্যমুখীকৃত অপমান ক্রমে বিলুপ্ত হইতে লাগিল। সূৰ্য্যমুখী আর মনে স্থান পাইলেন না—-নগেন্দ্ৰই সৰ্ব্বত্র। ক্রমে কুন্দ ভাবিতে লাগিল, “আমি কেন সে গৃহ ত্যাগ করিয়া আসিলাম ? ফুটো কথায় আমার কি ক্ষতি হইয়াছিল ? আমি ত নগেন্দ্রকে দেখিতাম । এখন যে একবারও দেখিতে পাই না । তা আমি কি আবার ফিরে সে বাড়ীতে যাব ? তা যদি আমাকে তাড়াইয়া না দেয়, তবে আমি যাই । কিন্তু পাছে আবার তাড়াইয় দেয় ?” কুন্দনন্দিনী দিবানিশি মনোমধ্যে এই চিন্তা করিত। দত্তগুহে প্রত্যাগমন কৰ্ত্তব্য কি না, এ বিচার আর বড় করিত না—সেটা দুই চারি দিনে স্থির সিদ্ধান্ত হইল যে, যাওয়াই কৰ্ত্তব্য—নহিলে প্রাণ যায়। তবে গেলে সূৰ্য্যমুখী পুনশ্চ দূরীকৃত করিবে কি না, ইহাই বিবেচ্য হইল । শেষে কুন্দের এমনই তুর্দশা হইল যে, সে সিদ্ধান্ত করিল, সূৰ্য্যমুখী দূরীকৃতই করুক আর যাই করুক, যাওয়াই স্থির। কিন্তু কি বলিয়া কুন্দ আবার গিয়া সে গৃহ-প্রাঙ্গণে দাড়াইবে ? একা ত যাইতে বড় লজ। করে—তবে হীরা যদি সঙ্গে করিয়া লইয়া যায়, তা হলে যাওয়া হয়। কিন্তু ইরাকে মুখ ফুটিয়া বলিতে বড় লজ্জা করিতে লাগিল। মুখ ফুটিয়া বলিতেও পারিল না। হৃদয়ও আর প্রাণাধিকের অদর্শন সহ্য করিতে পারে না। এক দিন দুই চারি দণ্ড রাত্রি থাকিতে কুন্দ শয্যাত্যাগ করিয়া উঠিল। হীরা তখন নিদ্রিত। নিঃশব্দে কুন্দ স্বারোদঘাটন করিয়া বাটীর বাহির হইল। কৃষ্ণপক্ষাবশেষে ক্ষীণচন্দ্র আকাশপ্রান্তে সাগরে নিক্ষিপ্ত বালিকা সুন্দরীর হ্যায় ভাসিতেছিল। বৃক্ষান্তরাল মধ্যে রাশি রাশি অন্ধকার লুকাইয়াছিল। অতি মন্দ শীতল বায়ুতে পথিপাৰ্শস্থ সরোবরের পদ্মপত্রশৈবালাদিসমাচ্ছন্ন জলের বীচিবিক্ষেপ হইতেছিল না। অস্পষ্টলক্ষ্য বৃক্ষাগ্রভাগ সকলের উপর নিবিড় । নীল আকাশ শোভা পাইতেছিল। কুকুরের পথিপার্শ্বে নিদ্রা যাইতেছিল। প্রকৃতি