বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বীরবলের হালখাতা - প্রমথ চৌধুরী.pdf/১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

কথার কথা

সম্প্রতি বাংলা-ব্যাকরণ নিয়ে আমাদের ক্ষুদ্র সাহিত্যসমাজে একটা বড়োরকম বিবাদের সূত্রপাত হয়েছে। আমি বৈয়াকরণ নাই, হবারও কোনো ইচ্ছে নেই। আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত লাইব্রেরি মুসলমানরা ভস্মসাৎ করেছে বলে সাধারণত লোকে দুঃখ করে থাকে, কিন্তু প্রসিদ্ধ ফরাসি লেখক মনটেইনের মনোভাব এই যে, ও ছাই গেছে বাঁচা গেছে। কেননা, সেখানে অভিধান ও ব্যাকরণের এক লক্ষ গ্রন্থ ছিল। ‘বাবা! শুধু কথার উপর এত কথা!” আমিও মনটেইনের মতে সায় দিই। যেহেতু আমি ব্যাকরণের কোনো ধার ধারি নে, সুতরাং কোনো ঋষিঋণমুক্ত হবার জন্য এ বিচারে তোমার যোগ দেবার কোনো আবশ্যক ছিল না। কিন্তু তর্ক-জিনিসটে আমাদের দেশে তরল পদার্থ, দেখতে-না-দেখতে বিষয় হতে বিষয়ান্তরে অবলীলাক্রমে গড়িয়ে যাওয়াটাই তার স্বভাব। তৰ্কটা শুরু হয়েছিল ব্যাকরণ নিয়ে, এখন মাঝামাঝি অবস্থায় অলংকারশাস্ত্রে এসে পৌঁছেছে, শেষ হবে বোধ হয় বৈরাগ্যে। সে যাই হোক, পণ্ডিত শরচ্চন্দ্র শাস্ত্রী মহাশয় এই মত প্রচার করেছেন যে, আমরা লেখায় যত অধিক সংস্কৃত শব্দ আমদানি করব ততই আমাদের সাহিত্যের মঙ্গল। আমার ইচ্ছে, বাংলা-সাহিত্য বাংলাভাষাতেই লেখা হয়। দুর্বলের স্বভাব, নিজের পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারে না। বাইরের একটা আশ্রয় আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। আমরা নিজের উন্নতির জন্যে পরের উপর নির্ভর করি। স্বদেশের উন্নতির জন্যে আমরা বিদেশীর মুখাপেক্ষী হয়ে রয়েছি, এবং একই কারণে নিজভাষার শ্রীবৃদ্ধির জন্যে অপর ভাষার সাহায্য ভিক্ষা করি। অপর ভাষা যতই শ্রেষ্ঠ হোক-না কেন, তার অঞ্চল ধরে বেড়ানোটা কি মনুষ্যত্বের পরিচয় দেয়? আমি বলি, আমরা নিজেকে একবার পরীক্ষা করে দেখি-না কেন। ফল কী হবে, কেউ বলতে পারে না; কারণ কোনো সন্দেহ নেই যে, সে পরীক্ষা আমরা পূর্বে কখনো করি নি। যাক ও-সব বাজে কথা। আমি বাংলাভাষা ভালোবাসি, সংস্কৃতকে ভক্তি করি। কিন্তু এ শাস্ত্র মানি নে যে, যাকে শ্রদ্ধা করি তারই শ্রাদ্ধ করতে হবে। আমার মত ঠিক কিংবা শাস্ত্রীমহাশয়ের মত ঠিক, সে বিচার আমি করতে বসি নি। শুধু তিনি যে যুক্তিদ্বারা নিজের মত সমর্থন করতে উদ্যত হয়েছেন, তাই আমি যাচিয়ে দেখতে চাই।

 কেউ হয়তো প্রথমেই জিজ্ঞাসা করতে পারেন, বাংলাভাষা কাকে বলে। বাঙালির মুখে এ প্রশ্ন শোভা পায় না। এ প্রশ্নের সহজ উত্তর কি এই নয় যে, যে ভাষা