পাতা:বীরবলের হালখাতা - প্রমথ চৌধুরী.pdf/১১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

à èR বীরবলের হালখাতা বীরপুরুষ-নামক জীবের সঙ্গে অবশ্য আমাদের সাক্ষাৎ-পরিচয় নেই। যাত্ৰাদলের ভীম আর থিয়েটারের প্রতাপাদিত্য হচ্ছে আমাদের বীরত্বের আদর্শ। কিন্তু রঙ্গভূমির বীরত্ব এবং রণভূমির বীরত্বের মধ্যে নিশ্চয়ই অনেকটা প্ৰভেদ আছে। কেননা, অভিনয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে লোককে আমোদ দেওয়া আর যুদ্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে লোককে পীড়ন করা। সুতরাং আসল বীররস যে-পরিমাণে করুণ-রসাত্মক নকল বীররস। সেই-পরিমাণে হাস্যরসাত্মক । এর এক থেকে অবশ্য অপরের পরিচয় পাওয়া যায় না । তবে যে-সকল গুণের সমবায়ে বীরচরিত্র গঠিত হয় তার একটি বাদ আর সব গুণই আমাদের শরীরে আছে বলে বীরত্বের বিচার করবার পক্ষে আমরা বিশেষরূপে যোগ্য । শুনতে পাই, ধৈৰ্য হচ্ছে বীর্যের একটি প্ৰধান অঙ্গ। এ গুণে তোমাদের অপেক্ষা আমরা শতগুণে শ্রেষ্ঠ । ব্ৰত নিয়ম উপবাস জাগরণে আমরা নিত্যঅভ্যস্ত, সুতরাং কষ্টসহিষ্ণুতা আমাদের অঙ্গের ভূষণ ; বিনা-বিচারে বিনা-ওজরে পরের হুকুমে চলা নাকি যোদ্ধার একটি প্ৰধান ধর্ম। এ ধর্ম আমাদের মতো কে পালন করতে পারে ? আমাদের মতো কলের পুতুল জর্মানির রাজকারখানাতেও তৈরি হয় নি। তার পর, কারণে কিংবা অকারণে অকাতরে প্রাণ দেওয়া যদি বীরত্বের পরাকাষ্ঠা হয়, তা হলে আমরা বীরশ্রেষ্ঠ ; কারণ তোমাদের পিতামহেরা যখন জ্বরে মরতেন। সেইসঙ্গে আমরা পুড়ে মরতুম। এ-সব গুণ সত্ত্বেও যে আমরা বীরজাতি বলে গণ্য হই নি তার কারণ আমরা পরের জন্য মরতে জানি। কিন্তু পরকে মারতে জানি নে। যে প্ৰবৃত্তির অভাব-বশত স্ত্রীধর্ম হেয়, আর সম্ভাব্যবশত ক্ষত্রধর্ম শ্রেয়- সে হচ্ছে হিংসা। বীরপুরুষ কিছুই সাধ করে ত্যাগ করতে চান না ; সবই গায়ের জোরে ভোগ করতে চান। শাস্ত্রে বলে, "বীরভোগা বসুন্ধরা” । বীরের ধর্ম হচ্ছে, পৃথিবীর সুবর্ণপুষ্প চয়ন করা ; অবশ্য আমরাও তার অন্তর্ভূত। তাই আমাদের সঙ্গে বীরপুরুষের চিরকাল ভক্ষ্য-ভক্ষক সম্বন্ধ। বীর প্রাণ দান করতে পারেন। না, যদি যুদ্ধক্ষেত্রে দৈবাৎ তা হারান তো সে তঁর কপাল আর র্তার শত্রুর হাতিযশ। বীরত্বের মান্য আজও যে পৃথিবীতে আছে তার কারণ বীরত্ব মানুষের মনে ভয়ের উদ্রেক করে, শ্রদ্ধার নয়। সুতরাং যুদ্ধের মাহাত্ম্য মানুষের বল নয় দুর্বলতার উপরেই প্ৰতিষ্ঠিত। যে কাজ মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক নয়, মানুষের ভীরুতাই যার মূলভিত্তি, যে কর্মের ফলে সমাজের অশেষ ক্ষতি হয়- তা যে কী করে ধর্ম হতে পারে তা আমাদের ধর্মজ্ঞানে আসে না । পুৱাকালে পুরুষ-মানুষে যুদ্ধ-করাটাই ধৰ্ম মনে করতেন এবং স্ত্রীলোকে চিরকালই তা অধৰ্ম মনে করত। কালক্রমে পুরুষের মনেও এ বিষয়ে ধর্মধর্মের জ্ঞান জন্মেছে। এখন যুদ্ধ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত, এক ধর্মযুদ্ধ আর-এক অধৰ্মযুদ্ধ। শুনতে পাই,এ,