পাতা:বীরবলের হালখাতা - প্রমথ চৌধুরী.pdf/১১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নারীর পত্রের উত্তর আমরা স্ত্রীজাতিকে সমাজে স্বাধীনতা দিই নি, কিন্তু সাহিত্যে দিয়েছি। আজকাল বাংলাভাষায় লেখকের চাইতে লেখিকার সংখ্যাই বেশি। সম্ভবত সেই কারণে মাসিকপত্ৰসকল "পত্রিকা”সংজ্ঞা ধারণ করেছে। স্ত্রীজাতি এতদিন সে স্বাধীনতার অপব্যবহার করেন নি ; কেননা, মতামতে তারা একালযাবৎ আমাদেরই অনুসরণ করে আসছেন। বাংলায় স্ত্রী-সাহিত্য জলমেশানো পুং-সাহিত্য, বৈ আর-কিছুই নয়, সুতরাং সে সাহিত্য পরিমাণে বেশি হলেও আমাদের সাহিত্যের চাইতেও ওজনে ঢের कब छिल । কিন্তু লেখিকারা যদি স্ত্রী-মনোভাব প্ৰকাশ করতে শুরু করেন, তা হলে তঁদের কথা আর উপেক্ষা করা চলবে না। এই কারণে, এইসঙ্গে যে 'নারীর পত্র’খনি পাঠাচ্ছি, তার মতামত সম্বন্ধে সসংকোচে দুটি-একটি কথা বলতে চাই। লেখিকার মূলকথার বিরুদ্ধে বিশেষ-কিছু বলবার নেই। সে কথা হচ্ছে এই যে, যুদ্ধ না-করা স্ত্রীজাতির পক্ষে স্বাভাবিক। এই স্বতঃসিদ্ধ সত্য প্ৰমাণ করবার জন্য অত বাগজাল বিস্তার করবার আবশ্যক ছিল না। অপর পক্ষে, যুদ্ধ করা যে পুরুষের পক্ষে স্বাভাবিক, তা প্ৰমাণ করাও অনাবশ্যক। এই সত্যটি মেনে নিলে লেখিকা দৰ্শন-বিজ্ঞানের প্রতি অত আক্রোশ প্রকাশ করতেন না। দৰ্শন-বিজ্ঞান যুদ্ধের স্বষ্টি করে নি, যুদ্ধই তদনুরূপ দৰ্শন-বিজ্ঞানের সৃষ্টি করেছে। ক্ষত্ৰিয়ের অস্ত্র হচ্ছে ব্ৰাহ্মণের পৃষ্ঠপোষক, তাই ব্ৰাহ্মণের শাস্ত্ৰ ক্ষত্ৰিয়ের চিত্ততোষক হতে বাধ্য। এ দুই জাতির ভিতর স্পষ্ট সাংসারিক বাধ্যবাধকতার সম্বন্ধ আছে ; কিন্তু যুদ্ধজীবীর সঙ্গে বুদ্ধিজীবীর যে একটি মানসিক বাধ্যবাধকতাও আছে তা সকলের কাছে তেমন সুস্পষ্ট নয়। একদল মানুযে যা করে, আর-এক দলে হয় তার ব্যাখ্যান নয় ব্যাখ্যা করে । কৰ্মবীর জ্ঞানহীন হতে পারে, এবং জ্ঞানবীর কর্মহীন হতে পারে ; কিন্তু পৃথিবীতে কর্ম না থাকলে জ্ঞানও থাকত না। কর্ম জ্ঞানবৃক্ষের ফল নয়, জ্ঞান কর্মবৃক্ষের ফুল। সুতরাং যুদ্ধের দায়িত্ব দৰ্শন-বিজ্ঞানের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে উধের বোঝা বুধের ঘাড়ে চাপানো। মানুষ যতদিন যুদ্ধ করবে, মানুষে ততদিন হয় তার সমর্থন নয় তার প্রতিবাদ করবে। মানুষকে ঝগড়া-লড়াই করতে উসকে দেওয়াই যে জ্ঞানের একমাত্র কাজ, তা অবশ্য নয়। জ্ঞানীমাত্রেই যে নারদ নন, তার প্রমাণ স্বয়ং বুদ্ধদেব। লেখিকা ধৰ্মযুদ্ধ এবং অধৰ্মযুদ্ধের পার্থক্য স্বচ্ছন্দচিত্তে মানতে চান না। তার মতে এই ‘অভেদ পার্থক্যে’র আবিষ্কারে পুরুষজাতি বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন, হৃদয়ের নয়।