পাতা:বীরবলের হালখাতা - প্রমথ চৌধুরী.pdf/১৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

StrՀ বীরবলের হালখাতা সংস্কৃত-মতে বসন্ত মদন-সখা । মানসিজের দর্শনলাভের জন্য মানুষকে প্ৰকৃতির দ্বারস্থ হতে হয় না । কেননা, মন যার জন্মস্থান, তার সাক্ষাৎ মনেই মেলে । ও-বস্তুর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই মনের দেশের অপূর্ব রূপান্তর ঘটে। তখন সে রাজ্যে ফুল ফোটে, পাখি ডাকে, আকাশ-বাতাস বৰ্ণে-গন্ধে ভরপুর হয়ে ওঠে। মানুষের স্বভাবই এই যে, সে বাইরের বস্তুকে অন্তরে আর অন্তরের বস্তুকে বাইরে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এই ভিতরে-বাইরের সমন্বয় করাটাই হচ্ছে আত্মার ধর্ম। সুতরাং মনসিজের প্রভাবে মানুষের মনে যে রূপ রাজ্যের সৃষ্টি হয়, তারই প্ৰতিমূৰ্তিস্বরূপে বসন্তঋতু কল্পিত হয়েছে ; আসলে ও-ঋতুর কোনো অস্তিত্ব নেই। এর একটি অকাট্য প্রমাণ আছে। যে শক্তির বলে মনোরাজ্যের এমন রূপান্তর ঘটে, সে হচ্ছে যৌবনের শক্তি। তাই আমরা বাসস্থ্যকে প্রকৃতিব যৌবনকাল বলি, অথচ এ কথা আমরা কেউ ভাবি নে যে, জন্মাবামাত্র যৌবন কারো দেহ আশ্ৰয় করে না ; অথচ পয়ল ফান্ধন যে বসন্তের জন্মতিথি, এ কথা আমরা সকলেই জানি। অতএব দাঁড়াল এই যে, বসন্ত প্ৰকৃতির রাজ্যে একটা অ্যারোপিত ঋতু। আমার এ-সব যুক্তি যদিও সুষুক্তি না হয়, তা হলেও আমাদের মেনে নিতে হবে যে বসন্ত মানুষের মনঃকল্পিত ; নচেৎ আমাদের স্বীকার করতে হয় যে, বসন্ত ও মনোজ উভয়ে সমধর্মী হলেও উভয়েরই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। বলা বাহুল্য, এ কথা মানার অর্থ সংস্কৃতে যাকে বলে দ্বৈতবাদ এবং ইংরেজিতে প্যারালালিজম - সেই বাতিল দর্শনকে গ্ৰাহ করা। সে তো অসম্ভব । অবশ্য অনেকে বলতে পারেন যে, বসন্তের অস্তিত্বই প্ৰকৃত এবং তার প্রভাবেই মানুষের মনের যে বিকার উপস্থিত হয়, তারই নাম মনসিজ । এ তো পাকা জড়বাদ, অতএব বিনা বিচারে অগ্ৰাহা । আমার শেষকথা এই যে, এ পৃথিবীতে বসন্তের যখন কোনোকালে অস্তিত্ব ছিল না, তখন সে অস্তিত্বের কোনোকালে লোপ হতে পারে না । আমরা ও-বস্তু যদি হারাই তবে সে আমাদের অমনোযোগের দরুন । যে জিনিস মানুষের মন গড়া তা মানুষের মন দিয়েই খাড়া রাখতে হয়। পূর্ব-কবিরা কায়মনোবাক্যে যো-রূপেরঋতু গড়ে তুলেছেন, সেটিকে হেলায় হারানো বুদ্ধির কাজ নয়। সুতরাং বৈজ্ঞানিকের যখন বস্তুগত্যা প্ৰকৃতিকে মানুষের দাসী করেছেন, তখন কবিদের কর্তব্য হচ্ছে কল্পনার সাহায্যে তার দেবীত্ব রক্ষণ করা । এবং এ উদ্দেশ্য সাধন করতে হলে তার মূর্তির পূজা করতে হবে ; কেননা, পূজা না পেলে দেবদেবীরা যে অন্তর্ধান হন, এ সত্য তো ভুবনবিখ্যাত। দেবতা যে মন্ত্রাত্মক। আর এ পূজা যে অবশ্য কর্তব্য তার কারণ, বসন্তু যদি অত:পর আমাদের অন্তরে লাট খেয়ে যায়, তা হলে সরস্বতীর সেবকেরা