VSTU a বোঝাতে হয় না, অথচ একই মনোভাব ভাষান্তরে বাউলের গানে এবং উপনিষদে দেখা দেয়। আত্মা যেমন এক দেহ ত্যাগ করে অপর দেহ গ্ৰহণ করলে পূৰ্বদেহের স্মৃতিমাত্রও রক্ষা করে না, মনোভাবও যদি তেমনি এক ভাষার দেহত্যাগ ক’রে অপর একটি ভাষার দেহ অবলম্বন করে, তা হলেই সেটি যথার্থ অনূদিত হয়। উপযুক্ত তরজমার গুণেই বৈদান্তিক মনোভাবসকল হিন্দুসন্তানমাত্রেরই মনে অল্পবিস্তর জড়িয়ে আছে। এ দেশে এমন লোক বোধ হয় নেই, যার মনটিকে নিৎড়ে নিলে অন্তত এক ফোটাও গৈরিক রঙ না পাওয়া যায়। আৰ্যসভ্যতার প্ৰেতাত্মা উদ্ধার করবার চেষ্টাটা একেবারেই অনর্থক, কারণ তার আত্মাটি আমাদের দেহাভ্যন্তরে সুষুপ্ত অবস্থায় রয়েছে, যদি আবশ্যক হয় তো সেটিকে সহজেই জাগিয়ে নেওয়া যেতে পারে। ঠিক কথাটি বলতে পারলে অপরের মনের দ্বার আরব্য-উপন্যাসের দস্যদের ধনভাণ্ডারের দ্বারের মতো। আপনি খুলে যায়। আমরা, ইংরেজি-শিক্ষিত লোকের জনসাধারণের মনের দ্বার খোলবার সংকেত জানি নে, কারণ আমরা তা জানিবার চেষ্টাও করি নে। যে-সকল কথা আমাদের মুখের উপর আলগা হয়ে রয়েছে কিন্তু মনে প্ৰবেশ করে নি, সেগুলি আমাদের মুখ থেকে খসে পড়লেই যে অপরের অন্তরে প্রবেশলাভ করবে, এ আশা বৃথা । আমরা যে আমাদের শিক্ষালব্ধ ভাবগুলি তরজমা করতে অকৃতকাৰ্য হয়েছি, তার প্ৰমাণ তো সাহিত্যে এবং রাজনীতিতে দু বেলাই পাওয়া যায়। যেমন সংস্কৃত-নাটকের প্ৰাকৃত ‘সংস্কৃত-ছায়া’র সাহায্য ব্যতীত বুঝতে পারা যায় না, তেমনি আমাদের নবসাহিত্যের কৃত্রিম প্ৰাকৃত ইংরেজি-ছায়ার সাহায্য ব্যতীত বোঝা যায় না। সমাজে না হোক, সাহিত্যে ‘চুরি বিদ্যে বড়োবিছো যদি না পড়ে ধরা’। কিন্তু আমাদের নব-সাহিত্যের বস্তু যে চোরাই-মাল, তা ইংরেজি-সাহিত্যের পাঠকমাত্রেরই কাছে ধরা পড়ে। আমরা ইংরেজি-সাহিত্যের সোনারুপো যা চুরি করি, তা গলিয়ে নিতেও শিখি নি। এই তো গেল সাহিত্যের কথা । রাজনীতি বিষয়ে আমাদের সকল ব্যাপার যে আগাগোড়াই নকল, এ বিষয়ে বোধ হয়। আর দু-মত নেই, সুতরাং সে সম্বন্ধে বেশি-কিছু বলা নিতান্তই নিম্প্রয়োজন। আমাদের মনে-মনে বিশ্বাস যে, ধর্ম এবং দর্শন এই দুটি জিনিস আমাদের একচেটি ; এবং অন্য কোনো বিষয়ে না হোক, এই দুই বিষয়ে আমাদের সহজ কৃতিত্বকেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ইংরেজি-শিক্ষিত ভারতবাসীদের এ বিশ্বাস যে সম্পূর্ণ অমূলক, তার প্ৰমাণস্বরূপ দেখানো যেতে পারে যে, ঐ শ্রেণীর লোকের হাতে মনুর ধর্ম রিলিজিঅন হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ ভুল তরজমার বলে ব্যবহারশান্ত্র আধ্যাত্মিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে। ধর্মশাস্ত্র এবং মোক্ষশাস্ত্রের ভেদজ্ঞান আমাদের লুপ্ত হয়েছে। ধর্মের অর্থ ধরে রাখা এবং
পাতা:বীরবলের হালখাতা - প্রমথ চৌধুরী.pdf/৪৫
অবয়ব