পাতা:বীরবলের হালখাতা - প্রমথ চৌধুরী.pdf/৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বঙ্গসাহিত্যের নবযুগ VV) এই হচ্ছে সংসারের নিয়ম। সুতরাং ছবির পাশাপাশি তার সমালোচনাও সাহিত্যে দেখা দিতে বাধ্য। এই কারণেই যেদিন থেকে বাংলাদেশে চিত্ৰকলা আবার নবকলেবর ধারণ করেছে, তার পরদিন থেকেই তার অনুকুল এবং প্রতিকূল সমালোচনা শুরু হয়েছে। এবং এই মতদ্বৈধ থেকে সাহিত্যসমাজে একটি দলাদলির সৃষ্টি হবার উপক্রম হয়েছে। এই তর্কযুদ্ধে আমার কোনো পক্ষ অবলম্বন করবার সাহস নেই। আমার বিশ্বাস, এ দেশে একালের শিক্ষিত লোকদের মধ্যে চিত্রবিদ্যায় বৈদগ্ধ্য এবং আলেখ্য-ব্যাখ্যানে নিপুণতা অতিশয় বিরল, কারণ এ যুগের বিদ্যার মন্দিরে সুন্দরের প্রবেশ নিষেধ। তবে বঙ্গদেশের নব্য চিত্র সম্বন্ধে সচরাচর যে-সকল আপত্তি উত্থাপন করা হয়ে থাকে, সেগুলি সংগত কি অসংগত তা বিচার করবার অধিকার সকলেরই আছে ; কেননা, সে-সকল আপত্তি কলাজ্ঞান নয়, সাধারণ জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত। যতদূর আমি জানি, নব্যচিত্রকরদের বিরুদ্ধে প্ৰধান অভিযোগ এই যে, তাদের রচনায় বণে-বর্ণে বানান-ভুল এবং রেখায়-রেখায় ব্যাকরণ-ভুল দৃষ্ট হয়। এ কথা সত্য কি মিথ্যা শুধু তারাই বলতে পারেন, যাদের চিত্রকর্মের ভাষার উপর সম্পূর্ণ অধিকার জন্মেছে ; কিন্তু সে ভাষায় সুপণ্ডিত ব্যক্তি বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে দেখতে পাওয়া যায়না, যদিচ ও-সকল স্থানে সমালোচকের দর্শন পাওয়া দুর্লভ নয়। আসল কথা হচ্ছে, এ শ্রেণীর চিত্ৰ-সমালোচকেরা অনুকরণ-অর্থে ব্যাকরণ-শব্দ ব্যবহার করেন। এদের মতে ইউরোপীয় চিত্রকরেরা প্ৰকৃতির অনুকরণ করেন, সুতরাং সেই অনুকরণের অনুকরণ করাটাই এ দেশের চিত্রশিল্পীদের কর্তব্য। প্ৰকৃতি-নামক বিরাট পদাৰ্থ এবং তার অংশভুত ইউরোপ-নামক ভূভাগ, এ উভয়ের প্রতি আমার যথোচিত ভক্তি-শ্রদ্ধা আছে ; কিন্তু তাই বলে তার অনুকরণ করাটাই যে পরমপুরুষাৰ্থ, এ কথা আমি কিছুতেই স্বীকার করতে পারি নে। প্ৰকৃতির বিকৃতি ঘটানো কিংবা তার প্রতিকৃতি গড়া কলাবিদ্যার কার্য নয়, কিন্তু তাকে আকৃতি দেওয়াটাই হচ্ছে আর্টের ধর্ম। পুরুষের মন প্ৰকৃতিনর্তিকীর মুখ দেখবার আয়না নয়। আর্টের ক্রিয়া অনুকরণ নয়, সৃষ্টি। সুতরাং বাহবিস্তুর মাপজোকের সঙ্গে আমাদের মানসজাত বস্তুর মাপজোক যে হুবাহুব মিলে যেতেই হবে, এমন-কোনো নিয়মে আটকে আবদ্ধ করার অর্থ হচ্ছে প্ৰতিভার চরণে শিকলি পরানো । আটে অবশ্য যথেচ্ছাচারিতার কোনো অবসর নেই। শিল্পীরা কলাবিদ্যার অনন্যসামান্য কঠিন বিধিনিষেধ মানতে বাধ্য, কিন্তু জ্যামিতি কিংবা গণিতশাস্ত্রের শাসন নয়। একটি উদাহরণের সাহায্যে আমার পূর্বোক্ত মতের যাথার্থের প্রমাণ অতি সহজেই দেওয়া যেতে পারে; একে একে যে দুই হয়, এবং একের পিঠে এক দিলে যে এগারো হয়- বৈজ্ঞানিক হিসেবে এর চাইতে খাটি সত্য পৃথিবীতে আর কিছুই নেই। অথচ একে একে দুই না হয়েও, এবং একের পিঠে