পাতা:বীরবলের হালখাতা - প্রমথ চৌধুরী.pdf/৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নোবেল প্রাইজ V2) না। ভবিষ্যতে ইংরেজি তরজমার দিকে এক নজর রেখে- এক নজর কেন, পুরো নজর রেখেই- আমাদের বাংলাসাহিত্য গড়তে হবে। অবশ্য আমরা সকলেই দোভাৰী, আর আমাদের নিত্য কাজই হচ্ছে তরজমা করা । কিন্তু সব্যসাচী হলেও এক তীরে দুই পাখি মেরে উঠতে পারি নে। আমরা যখন বাংলা লিখি, তখন ইংরেজির তরজমা করি।- কিন্তু সে না জেনে ; আর যখন ইংরেজি লিখি তখন বাংলার তরজমা করি।-- সেও না জেনে । কিন্তু এখন থেকে ঐ কাজই আমাদের সজ্ঞানে করতে হবে, মুশকিল তো ঐখানেই। মনোভাবকে প্ৰথমে বাংলাভাষার কাপড় পরাতে হবে, এই মনে রেখে যে, আবার তাকে সে কাপড় ছাড়িয়ে ইংরেজি পোশাক পরিয়ে সুইডিশ অ্যাকাডেমির সুমুখে উপস্থিত করতে হবে। এবং এর দরুন মনোভাবটির চেহারাও এমনি ত'য়ের করতে হবে যে, শাড়িতেও মানায় গাউনেও মানায় । এক ভাষাতে চিন্তা করাই কঠিন, কিন্তু একসঙ্গে যুগপৎ দুটি ভাষাতে চিন্তা করাটা অসম্ভব বললেও অত্যুক্তি হয় না। কিন্তু কায়ক্লেশে আমাদের সেই অসাধ্যসাধন করতেই হবে। একটি বাঙালি আর-একটি বিলেতি- এই দুটি স্ত্রী নিয়ে সংসার পাতা যে আরামের নয়, তা যারা ভুক্তিভোগী নন তঁরাও জানেন। তা ছাড়া, এ উভয়ের প্রতি সমান আসক্তি না থাকলে এ দুই সংসার করাও মিছে। সর্বভুতে সমদৃষ্টি, চাই কি, মানুষের হতেও পারে ; কিন্তু দুটি পত্নীতে সমান অনুরাগ হওয়া অসম্ভব, কেননা, মানুষের চোখ দুটি হলেও হৃদয় শুধু একটি। ন্ত্রৈণ হতে হলে একটিমাত্র স্ত্রী চাই। এমন-কি, দুই দেবীকে পূজা করতে হলেও পালা করে ছাড়া উপায়ান্তর নেই। অতএব দাঁড়াল এই যে, বছরের অর্ধেক সময় আমাদের বাংলা লিখতে হবে, আর অর্ধেক সময় ইংরেজিতে তার তরজমা করতে হবে। ফিরোফিরতি সেই সুইডেনের কথাই এল ; অর্থাৎ আমাদের চিদাকাশে ছমাস রাত আর ছমাস দিনের সৃষ্টি করতে হবে, অথচ দৈবশক্তি আমাদের কারো নেই। তৃতীয় মুশকিল। এই যে, সে তরজমার ভাষা চলতি হলে চলবে না। সে ভাষা ইংরেজি হওয়া চাই, অথচ ইংরেজের ইংরেজি হলেও হবে না। দেশী আত্মা এমনিভাবে বিলেতি দেহে প্ৰবেশ করিয়ে দেওয়া চাই, যাতে তার পূর্বজন্মের সংস্কার টুকু বজায় থাকে। ফুল ফোটাতে হবে বিলেতি, কিন্তু তার গায়ে গন্ধ থাকা চাই দেশী কুঁড়ির। প্ৰজাপতি ওড়াতে হবে বিলেতি, কিন্তু তার গায়ে রঙ থাকা চাই দেশী পোকার । এককথায়, আমাদের পূর্বের সূৰ্য পশ্চিমে ওঠাতে হবে। এহেন অঘটন-ঘটন-পটয়সী বিদ্যা অবশ্য আমাদের নেই। কাজেই যে কাৰ্য আমরা একদিন বাংলায় করতে চেষ্টা করে অকৃতকাৰ্য হয়েছি