পাতা:বীরবলের হালখাতা - প্রমথ চৌধুরী.pdf/৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সবুজ পত্ৰ ዓwo যে তার অর্থ বুঝতে পারি নে, তার কারণ হচ্ছে যিনি গুপ্ত জিনিস আবিষ্কার করতে ব্যস্ত, ব্যক্ত জিনিস র্তার চোখে পড়ে না । র্যার ইন্দ্ৰধনুর সঙ্গে চক্ষুষ পরিচয় আছে আর তার জন্মকথা জানা আছে, তিনিই জানেন যে, সূৰ্যকিরণ নানা বর্ণের একটি সমষ্টিমাত্র এবং শুধু সিধে পথেই সে সাদা ভাবে চলতে পারে। কিন্তু তার সৱল গতিতে বাধা পড়লেই সে সমষ্টি ব্যস্ত হয়ে পড়ে, বক্র হয়ে বিচিত্র ভঙ্গি ধারণ করে, এবং তার বর্ণসকল পাচ বর্গে বিভক্ত হয়ে যায়। সবুজ হচ্ছে এই বর্ণমালার মধ্যমণি, এবং নিজগুণেই সে বর্ণরাজ্যের কেন্দ্ৰস্থল অধিকার ক’রে থাকে ; বেগুনি কিশলয়ের রঙ, জীবনের পূর্বরাগের রঙ ; লাল রক্তের রঙ, জীবনের পূর্ণরাগের রঙ ; নীল আকাশের রঙ, অনন্তের রঙ ; পীত শুষ্কপত্রের রঙ, মৃত্যুর রঙ। কিন্তু সবুজ হচ্ছে নবীন পত্রের রঙ, রসের ও প্ৰাণের যুগপৎ লক্ষণ ও ব্যক্তি ; তার দক্ষিণে নীল আর বামে পীত, তার পূর্বসীমায় বেগুনি আর পশ্চিম সীমায় লাল। অন্ত ও অনন্তের মধ্যে, পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে, স্মৃতি ও আশার মধ্যে মধ্যস্থত করাই হচ্ছে সবুজের, অর্থাৎ সরস প্ৰাণের স্বধৰ্ম। যে বর্ণ বাংলার ওষধিতে ও বনস্পতিতে নিত্য বিকশিত হয়ে উঠছে, নিশ্চয় সেই একই বর্ণ আমাদের হৃদয়-মানকেও রঙিয়ে রেখেছে। আমাদের বাহিরের প্ৰকৃতির যে রঙ, আমাদের অন্তরের পুরুষেরও সেই রঙ। এ কথা যদি সত্য হয়, তা হলে সজীবতা ও সরসতাই হচ্ছে বাঙালির মনের নৈসৰ্গিক ধর্ম। প্ৰমাণস্বরূপে দেখানো যেতে পারে যে, আমাদের দেবতা হয় শ্যাম নয় শুষ্ঠামা । আমাদের হৃদয়মন্দিরে রাজতগিরিসন্নিভ কিংবা জবাকুসুমসংকাশ দেবতার স্থান নেই ; আমরা শৈবও নই, সৌরও নই। আমরা হয়। বৈষ্ণব, নয় শাক্ত। এই উভয়ের মধ্যে বঁশি ও অসির যা প্ৰভেদ, সেই পার্থক্য বিদ্যমান ; তবুও বর্ণসামান্যতার গুণে শ্যাম ও শ্যামা আমাদের মনের ঘরে নির্বিবাদে পাশাপাশি অবস্থিতি করে। তবে বঙ্গসরস্বতীর দূর্বাদলশ্যামরূপ আমাদের চোখে যে পড়ে না, তার জন্য দোষী আমরা নই, দোষী আমাদের শিক্ষা। একালের বাণীর মন্দির হচ্ছে বিদ্যালয় । সেখানে আমাদের গুরুরা এবং গুরুজনেরা যে জড় ও কঠিন শ্বেতাঙ্গী ও শ্বেতবসনা পাষাণমূর্তির প্রতিষ্ঠা করেছেন, আমাদের মন তার কায়িক এবং বাচিক সেবায় দিন-দিন নীরস ও নির্জীব হয়ে পড়ছে। আমরা যে নিজের আত্মার সাক্ষাৎকার লাভ করি নে, তার কারণ আমাদের নিজের সঙ্গে ! আমাদের কেউ পরিচয় করিয়ে দেয় না। আমাদের সমাজ ও শিক্ষা দুই আমাদের ব্যক্তিত্বের বিরোধী। সমাজ শুধু একজনকে আর-পাঁচজনের মতো হতে বলে, ভুলেও