ዓ 8 বীরবলের হালখাতা কখনো আর-পাঁচজনকে একজনের মতো হতে বলে না । সমাজের ধর্ম হচ্ছে প্ৰত্যেকেক্স স্বধৰ্ম নষ্ট করা । সমাজের যা মন্ত্র, তারই সাধনপদ্ধতির নাম শিক্ষা । তাই শিক্ষার বিধি হচ্ছে "অপরের মতো হও”, আর তার নিষেধ হচ্ছে ‘নিজের মতো হয়ে না’। এই শিক্ষার কৃপায় আমাদের মনে এই অদ্ভুত সংস্কার বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, আমাদের স্বধৰ্ম এতই ভয়াবহ যে তার চাইতে পারধর্মে নিধনও শ্রেয়। সুতরাং কাজে ও কথায়, লেখায় ও পড়ায়, আমরা আমাদের মনের সরস সতেজ ভাবটি নষ্ট করতে সদাই উৎসুক। এর কারণও স্পষ্ট, সবুজ রঙ ভালোমন্দ দুই অর্থেই কঁচা। তাই আমাদের কর্মযোগীরা আর জ্ঞানযোগীরা, অর্থাৎ শাস্ত্রীর দল, আমাদের মনটিকে রাতারাতি পাকা করে তুলতে চান। তঁদের বিশ্বাস যে, কোনোরূপ কর্ম কিংবা জ্ঞানের চাপে আমাদের হৃদয়ের রসাটুকু নিংড়ে ফেলতে পারলেই আমাদের মনের রঙ পেকে উঠবে। তঁদের রাগ এই যে, সবুজ বর্ণমালার অন্তস্থ বর্ণ নয়, এবং ও রঙ কিছুরই অন্তে আসে না- জীবনেরও নয়, বেদেরও নয়, কর্মেরও নয়, জ্ঞানেরও নয়। এদের চােখে সবুজ মনের প্রধান দোষ যে, সে মন পূর্বমীমাংসার অধিকার ছাড়িয়ে এসেছে এবং উত্তরমীমাংসার দেশে গিয়ে পৌছয় নি। এরা ভুলে যান যে, জোর করে পাকাতে গিয়ে আমরা শুধু হরিৎকে পীতের ঘরে টেনে আনি, প্ৰাণকে মৃত্যুর দ্বারস্থ করি। অপর দিকে এ দেশের ভক্তিযোগীরা, অর্থাৎ কবির দল, কঁচাকে কচি করতে চান। এরা চান যে, আমরা শুধু গদগদ ভাবে আধা-আধা কথা কই । এদের রাগ সবুজের সজীবতার উপর। এদের ইচ্ছা, সবুজের তেজটুকু বহিস্কৃত করে দিয়ে ছাকা রসাটুকু রাখেন। এরা ভুলে যান যে, পাতা কখনো আর কিশলয়ে ফিরে যেতে পারে না । প্ৰাণ পশ্চাৎপদ হতে জানে না ; তার ধর্ম হচ্ছে এগানো, তার লক্ষ্য হচ্ছে হয় অমৃতত্ব নয় মৃত্যু। যে মন একবার কর্মের তেজ ও জ্ঞানের ব্যোমের পরিচয় লাভ করেছে, সে এ উভয়কে অন্তরঙ্গ করবেই।- কেবলমাত্ৰ ভক্তির শাস্তিজলে সে তার সমস্ত হৃদয় পূর্ণ করে রাখতে পারে না। আসল কথা হচ্ছে, তারিখ এগিয়ে কিংবা পিছিয়ে দিয়ে যৌবনকে ফাকি দেওয়া যায় না। এ উভয়ের সমবেত চেষ্টার ফল দাড়িয়েছে এই যে বাঙালির মন এখন অর্ধেক অকালপক, এবং অর্ধেক অযথা-কচি। আমাদের আশা আছে যে, সবুজ ক্রমে পেকে লাল হয়ে উঠবে। কিন্তু আমাদের অন্তরের আজকের সবুজারস কালকের লাল রক্তে তবেই পরিণত হবে, যদি আমরা স্বধর্মের পরিচয় পাই, এবং প্ৰাণপণে তার চর্চা করি। আমরা তাই দেশী কি বিলেতি পাথরে-গড়া সরস্বতীর মূর্তির পরিবর্তে বাংলার কাব্যমন্দিরে দেশের মাটির ঘট-স্থাপনা করে তার মধ্যে সবুজ পত্রের প্রতিষ্ঠা করতে চাই। কিন্তু এ মন্দিরের কোনো
পাতা:বীরবলের হালখাতা - প্রমথ চৌধুরী.pdf/৭২
অবয়ব