পাতা:বীরবলের হালখাতা - প্রমথ চৌধুরী.pdf/৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

a বীরবলের হালখাতা ও দুই হচ্ছে বক্তাদের একচেট। লেখকেরা যদি বক্তাদের অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করেন, তা হলে বক্তারাও লিখতে শুরু করবেন, এবং সেটা উচিত কাজ হবে না । লেখবার নানারূপ বিষয় এইভাবে ক্ৰমে বাদ পড়ে গেলে শেষে একটিমাত্র জিনিসে গিয়ে ঠেকে, যার বিষয় নির্ভাবনায় অনর্গল লেখনী চালনা করা চলে, এবং সে হচ্ছে নীতি। নীতির মোটা আদেশ ও উপদেশগুলি সংখ্যায় এত কম যে, তা আঙুলে গোনা যায়, এবং সেগুলি এতই সর্বলোকবিদিত ও সর্ববাদিসম্মত যে সুস্থশরীরে স্বচ্ছন্দচিত্তে সে বিষয়ে এক-গঙ্গা লিখে যাওয়া যায় ; কেননা, কেউ যে তার প্রতিবাদ করবে, সে ভয় নেই। মানুষ যে দেবতা নয়, এবং মানবের পক্ষে দেবত্বলাভের চেষ্টা নিত্য ব্যর্থ হলেও যে নিয়ত কর্তব্য, সে বিষয়ে তিলমাত্র সন্দেহ নেই। তবুও অপরকে নীতির উপদেশ দিতে আমার তাদৃশ উৎসাহ হয় না। তার কারণ, মানুষ খারাপ বলে আমি দুঃখ করি নে, কিন্তু মানুষ দুঃখী বলে মন খারাপ করি। অথচ মানুষের দুৰ্গতির চাইতে দুনীতিটি বেশি চোখে না পড়লে নীতির গুরুগিরি করা চলে না। তা ছাড়া পরের কানে নীতির মন্ত্র দেওয়া সম্বন্ধে আমার মনে একটি সহজ অপ্ৰবৃত্তি আছে। যে-কথা সকলে জানে, সে-কথা যে আমি না বললে দেশের দৈন্য ঘুচিবে না, এমন বিশ্বাস আমি মনে পোষণ করতে পারি নে। এমন-কি, আমার এ সন্দেহও আছে যে, যারা দিন নেই রাত নেই অপরকে লক্ষ্মীছেলে হতে বলেন, তঁরা নিজে চান। শুধু লক্ষ্মীমন্ত হতে। যারা পরকে বলেন “তোমরা ভালো হও, ভালো করো’, তারা নিজেকে বলেন ‘ভালো খাও, ভালো পরো” । সুতরাং আমার পরামর্শ যদি কেউ জিজ্ঞাসা করেন, তা হলে আমি তঁকে বলব ‘ভালো খাও, ভালো পরো’। কারণ মানুষ পৃথিবীতে কেন আসে কোন যায়, সে রহস্য আমরা না জানলেও এটি জানি যে "ইতিমধ্যে।’ তার পক্ষে খাওয়া-পরাটা দরকার। “তোমরা ভালো খাও, ভালো পরে’, এ পরামর্শ সমাজকে দিতে অনেকে কুষ্ঠিত হবেন ; কেননা, ও-কথার ভিতর এইকথাটি উহ্য থেকে যায় যে, পরামর্শদাতাকে নিজে ভালো হতে হবে এবং ভালো করতে হবে। আপত্তি তো ঐখানেই । যিনি ভালো খান ও ভালো পরেন, সহজেই তঁর মনে নিজের শ্রেষ্ঠত্বের উপর বিশ্বাস জন্মে যায়, এবং সেইসঙ্গে এই ধারণাও তার মনে দৃঢ় হয়ে ওঠে যে, যেখানে দৈন্য সেইখানেই পাপ । দারিস্যের মূল যে দরিদ্রের দুনীতি, এই ধারণা একসময়ে ইউরোপের ধনীলোকের