পাতা:বীরবলের হালখাতা - প্রমথ চৌধুরী.pdf/৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বর্ষার কথা St উপকরণও এ ঋতুতে বড়ো একটা পাওয়া যায় না। এ ঋতু পাখি-দুট। বর্ষায় কোকিল মৌন, কেননা দদুৰ্ব বক্তা ; চকোর আকাশদেশত্যাগী, আর চাতক ঢের হয়েছে বলে ফটিকজাল শব্দ আর মুখে আনে না। যে-সকল চরণ ও চঞ্চুসার পাখি, যথা বিক হাঁস সারস হাড়গিলে ইত্যাদি, এ ঋতুতে স্বেচ্ছামত জলে-স্থলে ও নভোমণ্ডলে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করে, তাদের গঠন এতই অদ্ভুত এবং তাদের প্রকৃতি এতই তামসিক যে, তারা যে বিশ্বামিত্রের সৃষ্টি সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই। বস্তুতন্ত্রতার খাতিরে আমরা অনেক দূর অগ্রসর হতে রাজি আছি, কিন্তু বিশ্বামিত্রের জগৎ পৰ্যন্ত নয়। তার পর কাব্যের উপযোগী ফুল ফল লতা পাতা গাছ বর্ষায় এতই দুর্লভ যে, মহাকবি কালিদাসও ব্যাঙের ছাতার বর্ণনা করতে বাধ্য হয়েছেন। সংস্কৃতভাষার ঐশ্বর্ষের মধ্যে এ দৈন্য ধরা পড়ে না, তাই কালিদাসের কবিতা বেঁচে গেছে। বর্ষার দুটি নিজস্ব ফুল হচ্ছে কদম আর কেয়া। অপূর্বতায় পুষ্পজগতে এ দুটির আর তুলনা নেই। অপরাপর সকল ফুল অর্ধবিকশিত ও অর্ধনিমীলিত। রূপের যে অর্ধপ্ৰকাশ ও অর্ধগোপনেই তার মোহিনীশক্তি নিহিত, এ সত্য স্বর্গের অপসাররা জানতেন। মুনিঋষিদের তপোভঙ্গ করবার জন্য র্তারা উক্ত উপায়ই অবলম্বন করতেন । কারণ ব্যক্তি-দ্বারা ইন্দ্ৰিয় এবং অব্যক্ত-দ্বারা কল্পনাকে অভিভূত না করতে পারলে দেহ ও মনের সমষ্টিকে সম্পূর্ণ মোহিত করা যায় না, কদম কিন্তু একেবারেই খোলা, আর কেয়া একেবারেই বোজা । একের ব্যক্তি-রূপ নেই, অপরের গুপ্ত-গন্ধ নেই ; অথচ উভয়েই কণ্টকিত । এ ফুল দিয়ে কবিতা সাজানো যায় না। এ দুটি ফুল বর্ষার ভূষণ নয়, অস্ত্র ; গোলা এবং সঙিনের সঙ্গে এদের সাদৃশ্য স্পষ্ট। পূর্বে যা দেখানো গেল, সে-সব তো অঙ্গহীনতার পরিচয়। কিন্তু এ ঋতুর প্রধান দোষ হচ্ছে, আর-পাচটি ঋতুর সঙ্গে এর কোনো মিল নেই; আর-পাঁচটি ঋতুর সঙ্গে এ ঋতু খাপ খায় না। এ ঋতু বিজাতীয় এবং বিদেশী, অতএব অস্পৃশ্য। এই প্রক্ষিপ্ত ঋতু আকাশ থেকে পড়ে, দেশের মাটির ভিতর থেকে আবির্ভূত হয় না। বসন্তের নবীনতা সজীবতা ও সরসতার মূল হচ্ছে ধারণী । বসন্তের ঐশ্বৰ্য হচ্ছে দেশের ফুলে, দেশের কিশলয়ে। বসন্তের দক্ষিণপবনের জন্মস্থান যে ভারতবর্ষের মলয়পৰ্বত, তার পরিচয় তার স্পর্শেই পাওয়া যায় ; সে পবন আমাদের দেহে চন্দনের প্রলেপ দিয়ে দেয়। বসন্তের আলো, সুর্য ও চন্দ্রের আলো। ও দুটি দেবতা তো সম্পূর্ণ আমাদেরই আত্মীয় ; কেননা, আমরা হয়। সূৰ্যবংশীয় নয় চন্দ্ৰবংশীয়- এবং ভাবলীলা সংবরণ কঁৱে আমরা হয় সুৰ্যলোকে নয়। চন্দ্ৰলোকে ফিরে যাই । অপর পক্ষে, মেঘ যে কোন দেশ থেকে আসে, তার কোনো ঠিকানা নেই। বর্ষা যো-জলি বর্ষণ করে, সে কালাপানিৱ