পাতা:বৃহৎ বঙ্গ - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

উচ্চশ্রেণীর লোকেরা একেবারে বিলুপ্ত হন, নতুবা দেশান্তরী হইয়া আত্মরক্ষণ করেন। কিন্তু সমাজের নিম্নশ্রেণী সেই ঝড়ের উৎপাতে একেবারে নষ্ট হয় না। শাল, তমাল ভাঙ্গিয়া প্রভঞ্জন লীলা করেন, কিন্তু তিনি শ্যামদুর্ব্বাদলের একটিও শিখা ভাঙ্গেন না । দেশের প্ৰাচীনতম আচার, নীতি এমন কি শিক্ষা, দীক্ষা, কলাবিদ্যা-এ সমস্তই দেশের নিম্নতম শ্রেণীর কুটিরে লুকাইয়া আত্মরক্ষা করিয়া থাকে, এদেশে যে তাহা হইয়াছে তাহার ভূরি ভুরি প্রমাণ আমরা পরে দিব। এই নিয়শ্রেণীর লোকেরা জাতীয় প্রাচীন সম্পদের অন্তঃপুরের দুর্গস্বরূপ। ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতা এই অন্তঃপুরে যতটা রক্ষিত আছে-উচ্চশ্রেণীর সমাজে তাহা নাই। এই জন্যই কি ভাওয়ালের জঙ্গলে চণ্ডালেরা সেই প্ৰাচীন লিপি এখনও বজায় রাখিয়াছে? এবং প্রাজ্ঞমানী ভদ্ৰলোকেরা নাসিকা কুঞ্চন করিয়া সেই লিপির নাম দিয়াছেন “চাষীনাগরী ?” এই নাগরীতে লেখা পুথিও কিছু ছিল। বৌদ্ধদিগের অবলম্বিত লিপিকেই কি ব্ৰাহ্মণের “চাষা-নাগরী” নাম দিয়া তাহাদের ঘৃণা প্ৰদৰ্শন করিয়াছিলেন? ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দে, এই চাষা-নাগরীতে জ্ঞান-সম্পন্ন লোক ও চাষা-নাগরীতে লিখিত পুথি ভাওয়ালে চণ্ডালদের মধ্যে ছিল। এই ৫৭ বৎসরে কি তাহা লোপ পাইয়াছে? বিচিত্র নহে, কিন্তু ইহার খোঁজ করা একান্ত প্ৰয়োজন; অপিচ, এই “চাষা-নাগরী”র অর্থ কি “হিন্দুস্থানী লিপি”?-তাহা বলিয়া ত মনে হয না। হিন্দুস্থানীরা বহুকাল যাবৎ বাঙ্গলার নানা স্থানে বাস করিতেছে; তাহাদের নাগরীর সঙ্গে অনেকেরই পরিচয় আছে। তাহাদের নাগরীর এইরূপ অদ্ভুত নাম কেনই বা হইবে? ব্ৰাহ্মীলিপির জ্ঞান যদি এদেশে নষ্ট হইয়া থাকে, তবে তাহা বৌদ্ধবিদ্বেষের ফলে হইয়াছে। দেব নাগরীর প্রাধান্যের যুগে বৌদ্ধ যুগের লিপি হতাদৃত হইয়াছিল। এবং তজ্জন্যই তাহা সমাজের নিম্নস্তরে প্রচলিত থাকা অসম্ভব নহে। সেই লিপির “চাষা-নাগরী” নাম হওয়াও অসম্ভব নহে।

ত্রিপুরদেশে দ্রহ্যু

ত্ৰিপুত্রদেশ-যযাতিপুত্র দ্রহ্যুর ত্রিপুররাজ্যে আগমন সম্বন্ধেও বহু প্ৰবাদ এদেশে চলিয়া আসিয়াছে। পিতা কর্তৃক অভিশপ্ত দ্রহ্যু এক বর্ব্বর রাজ্যে চলিয়া গেলেন। মহাভারতের আদি পর্ব্বের ৮৩ অধ্যায়ে এই অভিশাপের বৃত্তান্ত লিখিত হইয়াছে। দ্রহ্যুকে যযাতি বলিলেন - “তুমি সেই দেশে যাও, যেখানে অশ্ব, গজ, রথ, গর্দ্দভ, ছাগ বা গো-বাহিত কোন যানবাহনের সুবিধা নাই। যেখানে একান্ত নিকটবৰ্ত্তী স্থানে যাইতে হইলেও ভেলার আশ্ৰয় করিতে হয় (বড় নৌকায় ঘাতায়াতের উপায় নাই) অথবা সাঁতার কাটিয়া যাইতে হয়।” কিন্তু সেই দেশ কোন দেশ, তাহা মহাভারতকার উল্লেখ করেন নাই। খিলহরিবংশে (৩০ অঃ, ১৬-২০ শ্লোক) উল্লিখিত হইয়াছে- যযাতি সসাগরা সপ্তদ্বীপা পৃথিবী পুত্রদিগকে বিভাগ করিয়া দিয়াছিলেন এই বিভাগানুসারে তাহার বিশাল সামাজের পশ্চিম ও উত্তর ভাগ দ্রহ্যু পাইয়াছিলেন বিষ্ণুপুরাণানুসারে (৪র্থ অংশ, ১০ম অঃ, ১৭/১৮ শ্লোক) দ্রহ্যু পশ্চিম দিক পাইয়াছিলেন শ্ৰীমদ্ভাগবতানুসারে (৯ম স্কন্ধ, ১৯ অঃ; ১৬/১৭ শ্লোক) তিনি দক্ষিণ-পূর্বদিকের অধিকার লাভ করিয়াছিলেন।