পাতা:বৃহৎ বঙ্গ - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পুরাণগুলির মধ্যে অনৈক্যের সামঞ্জএক্স্য করিবার জন্য শব্দকল্পদ্রুম-সংকলয়িতা রাধাকান্তদেব বাহাদুর বহু পণ্ডিত নিযুক্ত করিয়াছিলেন, তাহারা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিলেন-তাহা শব্দকল্পদ্রুমে লিখিত হইয়াছে। “যযাতি মরণ সময়ে কনিষ্ঠ পুত্ৰং পুরুং রাজচক্ৰবৰ্ত্তিনং কৃতবান। যদবে দক্ষিণ পূৰ্ব্বস্তাং কিঞ্চিদরাজ্যখণ্ড দত্তবান। তথা দ্রাহাবে পূৰ্ব্বস্তাং দিশি পশ্চিমায় তুৰ্ব্বসৰে উত্তরাস্তামিনবে সৰ্ব্বান পুরোরাধিনাং চক্ৰে।”

সুতরাং এই সিদ্ধান্ত অনুসারে দ্রহ্যু পূর্বদিক পাইয়াছিলেন। যাহারা দ্রহ্যু হইতে ত্রিপুররাজবংশাবলীর বংশলতা অঙ্কিত করেন তাহারা বলেন-“কোন কোন পুরাণে যে দ্রহ্যুকে পশ্চিমদিকে প্রেরণের কথা পাওয়া যায়, কল্পভেদে মূলবক্তা বা শ্রোতার বাসস্থানভেদে, বা দিকনির্ণয়ের কেন্দ্ৰভেদে তাহা ঘটিয়াছিল ইহাই বুঝা যায়।”

খাস ত্রিপুরার যে সকল সংস্কৃত ও বাঙ্গলা ইতিহাস আছে তাহার কতকগুলি ৪/৫ শত বৎসরের প্রাচীন; ইহাদের লেখকগণ সকলেই একবাক্যে ত্রিপুররাজগণের পূর্বপুরুষ যযাতি বলিয়া স্বীকার করিয়া লইয়াছেন। রাজরত্নাকরের ষষ্ঠ সর্গে ( ৪-১৮ শ্লোক দ্রষ্টব্য) ও রাজমালার প্রথম অধ্যায়েও এই কথা আছে। রাজমালা পুস্তকখানি প্ৰাচীন, ইহাতে লিখিত আছে যে চণ্ডেশ্বর ও বাণেশ্বর নামক শ্ৰীধৰ্ম্মমাণিক্য রাজার শ্ৰীহট্টনিবাসী দুই সভাপণ্ডিত ত্রিপুরা ইতিহাস সঙ্কলন করিতে নিযুক্ত হন। চতুর্দশ দেবতার প্রধান পাণ্ড দুৰ্লভেন্দ্ৰ (চন্তাই ) ইহাদিগকে সহায়তা করেন। তাহার রাজমালিকা, যোগিনীমালিকা, বারণ্যকায়নিৰ্ণয়, হরগৌরী সংবাদ ও লক্ষ্মণ মালিকা নামক সুপ্ৰাচীন সংস্কৃত ঐতিহ্যগ্রন্থ আলোচনা করিয়া বিশেষ চন্তাইগণ-কথিত তিপ্রাভাষায় প্রাচীন ইতিহাস শ্রবণপূর্বক রাজমালা সঙ্কলন করেন। রাজমালা পুস্তকখানি সেই যুগের বাঙ্গলা ভাষার একটা কীৰ্ত্তিস্তম্ভ। কাশ্মীরের রাজতরঙ্গিণী হইতেও ইহার বর্ণিত বৃত্তান্ত অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য; কিন্তু প্ৰথম কয়েক অধ্যায়ে অলৌকিক কাণ্ডকারখানা ও কল্পনার লীলাখেলা আছে। এই কয়েকটি অধ্যায় সম্বন্ধে অবশ্যই দ্বিধা আছে। ত্রিপুরার রাজবংশের অপেক্ষাকৃত আধুনিক ইতিহাস-লেখক কৈলাসচন্দ্ৰ সিংহ তথাকার রাজন্যবর্গের যযাতি হইতে উদ্ভবের দাবী অস্বীকার করিয়া তাহাদিগকে কামরূপের স্যানরাজাদের বংশধর বলিয়া মনে করেন এবং ‘বিশ্বকোষ’কার হরিবংশ ও বিষ্ণুপুরাণের মত গ্ৰহণ করিয়া দ্রহ্যুর পশ্চিম দেশে উপনিবেশ-স্থাপনের মতটারই পক্ষপাতী।

এই জটিল সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা এখানে না করাই শ্ৰেয়। যেহেতু প্ৰত্নতত্বের দিক দিয়া এই গ্ৰন্থ লিখিতে আমি সঙ্কল্প করি নাই। কিন্তু রাজরত্নাকরে ত্রিপুর হইতে বর্তমান প্রাঞ্চশ্ৰীযুক্ত মহারাজ বীরবিক্ৰমকিশোর মাণিক্য পৰ্যন্ত যে ১৮৪ জন নৃপতির বংশলতা পাওয়া যায়-তাহার অনেকাংশই ঐতিহাসিক বিচারসহ ও বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া মনে হয়। ত্রিপুর-রাজন্তবর্গের মত এরূপ দীর্ঘকাল রাজত্ব করিতে ভারতবর্ষের কর্তমান অন্য কোন বংশকে দেখা যায় না। বাঙ্গালীর পক্ষে ইহা কম গৌরবের কথা নহে। ভারতের ক্ষত্রিয়কুলতিলক চন্দ্ৰ-সূৰ্য্যবংশীয় ক্ষত্ৰিয়ত্বের অভিমানী আৰ্য্যাবর্তের প্রধান প্রধান রাজগোষ্ঠীর প্রায় সকলেই দেশান্তর আগত এবং উত্তরকালে ব্ৰাহ্মণানুগ্রহে হিন্দুধৰ্ম্ম ও সমাজের উচ্চ