পাতা:বৃহৎ বঙ্গ - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অনেক সময়ে বৃথা শাস্ত্ৰজ্ঞান দেখাইতে যাইয়া ইতিহাসকে হাস্যরসের এলাকায় পৰ্যন্ত লইয়া আসেন, তখন তাহাদের অবলম্বিত প্ৰবীণ অধ্যাপকোচিত গাম্ভীৰ্য কৌতুক ও কৃপার উদ্রেক করে।

আমার নিকট বঙ্গদেশের ইতিহাস সম্বন্ধীয় রাশি রাশি প্ৰাদেশিক ইতিহাস ছড়ানো রহিয়াছে। এই সকল ইতিহাসের কতকটা মূল্য স্বীকার করিতেই হইবে। অপেক্ষাকৃত আধুনিক যুগ সম্বন্ধে তাহাদের উল্লিখিত অনেক তথ্যই মূল্যবান; জনশ্রুতি লিপিবদ্ধ করা অন্যায় নহে, কিন্তু এই সকল প্ৰাদেশিক বিবরণীর আদিভাগে ইহারা যখন পৌরাণিক যুগের উল্লেখ করিয়াছেন, তখন অধিকাংশ স্থলেই ইহারা পাণ্ডুপুত্রদের লইয়া যুক্তি-তর্কের আড়ম্বর করিয়া বৃথা ধস্তাধস্তি করিয়াছেন। তাম্রশাসন, মুদ্রা প্ৰভৃতির প্রমাণ সম্বন্ধে অজ্ঞতা ও বৈজ্ঞানিক প্ৰণালী না জানার ফলে অনেক সময়ে তাহাদের ভ্রমগুলি উপহাসাম্পদ হইয়াছে। এতৎসম্বন্ধে একটি কণা এই যে নবব্রাহ্মণ্যের প্রচারকগণ সমস্ত দেশটা মহাভারতের জাল দিয়া ছাইয়া ফেলিয়াছিলেন। হিন্দুর পুরাণ ছাড়া এ দেশে আর কোন বিষয়ক ঘটনার অস্তিত্ব তাহারা স্বীকার করেন নাই। এইভাবে বিগত সহস্ৰ বৎসর পূর্বের সমস্ত ইতিহাস লুপ্ত হইয়া গিয়াছে।

আমরা দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি যে ইদানীন্তনকালে ব্ৰাহ্মণগণ যেখানে যেখানে বৌদ্ধযুগের নিদর্শন ছিল-তাহা রামায়ণ ও মহাভারতের যুগের ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করিতে চেষ্টা পাইয়াছেন। চন্দ্ৰ-সূৰ্যবংশের গৌরব লোকচক্ষে তাহারা খুব অতিরঞ্জিত করিয়া বৰ্ণনা করিয়াছেন। যেখানে যে কোন রাজা আছেন, তাঁহাদের আদি পুরুষকে মহাভারতের কোন দেশ-বিশ্রুত বীরের সঙ্গে গোজামিল দিয়া, বংশলতা টানিয়া আনিয়াছেন। বঙ্গদেশের সকল রাজার সম্বন্ধেই ঐরূপ ঘটিয়াছে। শুধু এদেশে নহে, রাজপুতনা প্রভৃতি দেশেও সুৰ্য্যবংশের গোজামিল একইভাবে হইয়াছে। ভারতের পশ্চিম দিকটা সূৰ্যবংশের ও পূর্ব দিকটা চন্দ্ৰবংশের লীলাক্ষেত্র হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সুতরাং রাজাদিগের আদিপুরুষের কথাটা একেবারে ইতিহাস হইতে বাদ দিলেও মন্দ হয় না। যতই কোন সংস্কৃত শ্লোক উদ্ভুত হউক না কেন, ঐতিহাসিকগণ এই সকল বংশ-লতার মুখপাত্‌টা খুব সুচক্ষে দেখিবেন না। বালি দ্বীপের হিন্দুগণ তাঁহাদের দেশে অযোধ্যা, সরযু, ইন্দ্ৰপ্ৰস্থ প্ৰভৃতি সমস্ত স্থানই দেখাইয়া থাকেন। এ দেশের ইতিহাসকেও ব্ৰাহ্মণগণ মহাভারতোক্ত তীর্থে পরিণত করিবার উদ্দেশ্যে বৌদ্ধেতিহাস মুছিয়া ফেলিয়া ছিলেন। যাহা হউক এই অধ্যায়ে যে সকল কথা লিখিত হইল তাহা হইতে একথা নিশ্চিতরূপে বলা যাইতে পারে যে, মহাভারতের যুগে আমাদের এই বৃহৎ বঙ্গ সাৰ্ব্বভৌম নৃপতিদের নিবাসভূমি ছিল। শিশুপালকে বাদ দিলেও জরাসন্ধ, পৌণ্ড্রবাসুদেব, নরক, ভগদত্ত প্ৰভৃতি রাজাৱা আর্যাবর্তের যে কোন নৃপতি হইতে শৌৰ্য, বীর্য ও ক্ষমতায় ন্যূন ছিলেন না; ইহারা এই দেশের প্রাচীন যুগের গৌরব।