পাতা:বৃহৎ বঙ্গ - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চরিত্রে সমাটের যোগ্য শৌৰ্যবীর্যের সঙ্গে সংযমের অপূৰ্ব্ব মহিমা মিশিয়া গিয়াছিল; তিনি তাঁহার কপটাচারী শত্রুদিগের সঙ্গে কথাবাৰ্ত্তায় শিশুপালের ন্যায় অসংযত ক্ৰোধ বা অপভাষা ব্যবহার করেন নাই। হঁহারই সিংহাসন উত্তর কালে মহারাজ প্রিয়দর্শী অশোক অলঙ্কৃত করিয়াছিলেন।

সর্ব্বপ্রধান অভিযোগ ও তাঁহার উদ্ভব

কৃষ্ণ মগধরাজের বিরুদ্ধে যে সকল অভিযোগ উপস্থিত করিয়াছিলেন, জরাসন্ধ তাহাদের সকলগুলিরই নিরসন করিয়াছিলেন। তাঁহার বিরুদ্ধে সৰ্ব্বপ্রধান অভিযোগ - তাহা আমরাও প্ৰতিবাদ করিতে দ্বিধা বোধ করি - তাহা তাঁহার মহাদেব মন্দিরে একশত রাজাকে বলি দেওয়ার সংকল্প।

এই নিষ্ঠুর ও বর্বরোচিত ব্যবহার সমর্থন করা যায় না। কিন্তু জরাসন্ধ এই অভিযোগের উত্তরে কি বলিয়াছিলেন, তাহা প্ৰণিধানযোগ্য -“হে কৃষ্ণ! আমি কোন রাজাকেই জয় না করিয়া আনয়ন করি নাই। বিক্রমপ্ৰকাশপূর্ব্বক লোককে আপনার বশে আনিয়া তাহার প্রতি স্বেচ্ছানুসারে ব্যবহার করাই ক্ষত্ৰিয়ের ধৰ্ম্ম।” সুতরাং দেখা যাইতেছে এই ৮৪ জন রাজা তাঁহার আনুগত্য স্বীকার করেন নাই, তিনি বিদ্রোহীদিগকে পরাজয় করিয়া বলপূর্বক ধরিয়া আনিয়াছিলেন। পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে জরাসন্ধ সাক্ষাৎ ক্ষাত্ৰধৰ্ম্মের প্রতীক ছিলেন । এই ক্ষাত্ৰনীতিরক্ষাকল্পে তিনি শত্রুদিগকে করায়ত্তে পাইয়াও তাঁহাদের প্রতি অলৌকিক মৰ্য্যাদা দেখাইয়াছিলেন এবং ত্ৰয়োদশ দিবস দিনরাত্ৰ অবিশ্ৰান্ত যুদ্ধের পর ভীমহস্তে নিহত হইয়াছিলেন। সেই যুগের রাজনীতির আদর্শ ভিন্নরূপ ছিল; কিন্তু তাহা যাহাই থাকুক না কেন, তিনি তাহা অক্ষরে অক্ষরে পালন করিয়াছিলেন। বন্দী রাজগণ সম্পর্কে তিনি কৃষ্ণকে বলিয়াছিলেন, “আমি ক্ষাত্ৰধৰ্ম্মাবলম্বী, দেবপূজার জন্য রাজগণকে আনিয়াছি, এখন কি নিমিত্ত ভয় পাইয়া তাহাদিগকে ত্যাগ করিব?” (মহাভারত, সভা, ২২ অঃ)

ক্ষত্ৰিশক্তির বিলোপ

আৰ্য্যাবৰ্ত্তের পূর্বাংশের এই সকল রাজগণের প্রায় সকলেই কৃষ্ণের বিরোধী ছিলেন, এই জন্যই কৃষ্ণ-সমশ্রিত নব ব্ৰাহ্মণসমাজ ইহাদিগকে স্বাক্ষস ও দানব বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন। ইহাদের কেহ কেহ ঈশ্বরে বিশ্বাস করিতেন না, নিজেরাই ঈশ্বর বলিয়া ঘোষণা করিতেন; পৌণ্ড্র বাসুদেব “ শঙ্খচক্ৰগদাধর” বলিয়া নিজেকে অভিহিত করিয়াছিলেন। যাহারা তাঁহার শাঙ্গ ধনু, পাঞ্চজন্য শঙ্খ ও কৌমোদকী গদার অনুশাসন মানিত না, তাহাদিগকে তিনি শাস্তি দিতেন। নরক, মুর, ভগদত্ত, বাণ প্রভৃতি রাজারা চিরকাল কৃষ্ণের সহিত শত্রুতা করিয়া আসিয়াছিলেন। ব্ৰাহ্মণেরা কৃষ্ণকে কেন্দ্ৰস্থানীয় করিয়া উত্তরপশ্চিমে যে নূতন হিন্দুসমাজ গঠন করিতেছিলেন পূৰ্ব্বদেশের সার্বভৌম রাজারা তাহার ঘোরতর বিরুদ্ধতা করিয়াছিলেন। মহাভারত, রামায়এন এই দুই হিন্দুসমাজের সর্বজনাদৃত গ্রন্থে ধৰ্ম্মসমন্বয়ের একটা চেষ্টা আছে; কিন্তু যে আকারে আমরা এই দুই পুস্তক পাইতেছি - তাহা সমধিক পরিমাণে কৃষ্ণের মহিমদ্যোতক।