পাতা:বৃহৎ বঙ্গ - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১১৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আৰ্য্যাবৰ্ত্তের এই অংশে পরবর্ত্তী কালে ক্ষত্ৰিয়াশক্তি একেবারে হ্রাস পাইয়াছিল। পুরাণে নন্দবংশ শূদ্ৰকুলজাত বলিয়া বর্ণিত আছে। এই বংশের স্থাপয়িতার সহিত পুরাণকার পরশুরামের উপমা দিয়া তাহাকে ক্ষত্ৰিকুলান্তক বলিয়া বৰ্ণনা করিয়াছেন। মৌৰ্য্যদের শূদ্রত্বও সৰ্ব্বজনস্বীকৃত। পরশুরামের পর কুরুক্ষেত্রে এবং তৎপরে নন্দদের দ্বারা ক্ষাত্রশক্তি বিশেষরূপ ক্ষুণ্ণ হইয়া পড়ে। এই যুগে জৈন ও বৌদ্ধধৰ্ম্মের অভ্যুদয়ে যজ্ঞাদি বিলুপ্ত হয়। যাহারা যজ্ঞের বিঘ্ন ঘটাইত, তাহারা দানব, রাক্ষস প্ৰভৃতি নামে পরিচিত হইয়াছিল। মার্কণ্ডেয় চণ্ডীতে দেখা যায় মৌৰ্য্যদিগকে দানবদের পঙ্‌ক্তিভূক্ত করা হইয়াছে।*

জৈন ও বৌদ্ধদিগের অধিকারকালে প্রাণিহিংসামূলক যজ্ঞাদি বহুপরিমাণে লুপ্ত হয়। আমাদের এই বৃহৎ বঙ্গ পূর্ব হইতে নব ব্ৰাহ্মণ্য-নেতা কৃষ্ণের বিদ্বেষী ছিল। এখানে কৃষ্ণবিরোধী দলের চেষ্টায় যজ্ঞাগ্নি বহুকালের জন্য একরূপ নির্বাপিত হইয়াছিল; এখানে নানাদেশীয় লোকের যতটা সমাগম ও মিশ্রণ হইয়াছিল– বোধ হয় ভারতের আর কোন দেশে ততটা হয় নাই। বাঙ্গালী বহুপূৰ্ব্ব হইতে সমুদ্রে যাতায়াত ভালবাসিতেন; সমুদ্রতীরবর্তী তমলুক এবং পূর্ববঙ্গে অধুনা-বিলুপ্ত কপিলাশ্রম প্রভৃতি স্থান প্ৰধান বাণিজ্যকেন্দ্র হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। চাম্পা, কম্বোজ, টংকিং, আনাম, জাবা, সুমিত্ৰা প্ৰভৃতি দেশের নানা মন্দির-গাত্রের ক্ষোদিত লিপি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আর্য্যাবর্ত্তের পূর্ব্বাংশের সমুদ্রে যাতায়াতে অতীব দক্ষ ছিলেন। বাঙ্গালীরা খৃষ্ট জন্মিবার বহুপূর্ব্বে সিংহলে উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছিলেন এবং তাঁহারা সমুদ্রপথে চীনদেশে গমনাগমন করিতেন। কথিত আছে, চীনদেশে উপনিবিষ্ট হিন্দুগণ চীনপতির সাহায্যে একদা ১,৮০০ নৌসেনা ও কতকগুলি রণতরী দিয়াছিলেন— ইহা খৃঃ পূঃ সপ্তম শতাব্দীর ঘটনা। ( বাঙ্গালীর বল, ২ পৃঃ, এবং J.R.A.S, 1696; Article by G. Philip.) খৃষ্ট জন্মিবার কিছু পরে বাঙ্গালীরা মাটাবান-তীরে উপনিবেশ-স্থাপনপূর্বক তথায় 'সদ্ধৰ্ম্ম' নামক নগর স্থাপন করিয়াছিলেন। মহাভারতে এবং অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থের অনেক স্থলে পূৰ্ব্বদেশীয় রাজাদের নৌবলের উল্লেখ পরিদৃষ্ট হয়।

সুতরাং শুধু নিকটবৰ্ত্তী পাহাড়িয়া জাতিদের সঙ্গে নহে, বাঙ্গালী সনাতনকাল হইতে বিভিন্ন জাতিদের সংস্পর্শে বিশেষভাবে আসিয়াছিল। কেহ কেহ বলেন, তাম্রলিপ্তির লোকেরাই আরও দক্ষিণ দেশে যাইয়া তামিল রূপে গণ্য হইয়াছে। তামিল ও তেলেগু জাতির সঙ্গে যে এককালে এদেশের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল তা হাতে সন্দেহ নাই। আসামের জনজাতি ও ব্রহ্মদেশের কিরাত ও চীনদেশবাসীগণ এদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলে বহুদিন প্ৰতিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁহারা ক্ৰমে ক্ৰমে হিন্দুসমাজের অন্তভুক্ত হইয়া গিয়াছেন। আমাদের দেশের লোকেদের মধ্যে অধুনা মস্ত বড় একটা বিচ্ছিন্নতার প্রাচীর তোলা হইয়াছে। পার্শ্ববৰ্ত্তী প্রতিবাসীদের সঙ্গে আহারাদি চলে না, অথচ কোন কোন জাতি-যথা, সূত্ৰধর প্রভৃতি,-তাহদের ব্যবসায়ে অপরিচ্ছন্নতার কিছুই নাই তথাপি সমাজ তাহাদিগকে ঠেকাইয়া

"কালকা দৌর্হৃতা মৌর্য্যঃ কালকেয়াস্তথাকুসরাঃ" চণ্ডী, অষ্টম মাহাত্ম্যম্‌