পাতা:বৃহৎ বঙ্গ - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/১১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাখিয়াছে, - একজাতীয় লোক হইলে এতটা বিচ্ছিন্নতা কিছুতেই ঘটিতে পারিত না। কোন কোন সময়ে রাজ-নিৰ্য্যাতনে অথবা রাষ্ট্ৰীয় পরিবর্তনের কালে শ্রেণী-বিশেষ অপদস্থ হইয়াছেন সত্য, কিন্তু সাধারণতঃ বিদেশাগত ভিন্নজাতির বংশধরগণকে হিন্দুসমাজে নিজেদের নিম্নস্তরে একটু জায়গা দিয়া তাহাদিগকে কতকটা ঘূণার চক্ষে দেখিয়াছেন, তাহারাই অধিকাংশ স্থলে অনাচরণীয় হইয়া রহিয়াছেন।

আমাদের প্রধান বক্তব্য এই যে, এদেশ ব্ৰাহ্মণ্য প্রভাব হইতে অনেকাংশে বিমুক্ত হইয়া দূরদেশসমূহের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদানের ফলে চিন্তাজগতে কতকটা স্বাধীনতা পাইয়াছিল। এ দেশে কোন দিনই পরের অত্যাচার এবং সামাজিক বা রাষ্ট্ৰীয় অনুশাসনের কঠোরতা সহ্য করিতে পারে নাই। গঙ্গা যেরূপ চিরচঞ্চল, পদ্মানদীর তীর যেরূপ সতত ভঙ্গশীল- এদেশের চিন্তা ও সামাজিক গঠন তেমনই অবিরাম গতিশীল। কৃষ্ণ-বিদ্বেষীদের ধ্বজার নিম্নে বৌদ্ধ ও জৈনধৰ্ম্ম বিশেষ পুষ্টিলাভ করিয়াছিল- কিন্তু সেই ধৰ্ম্ম দুইটিও বেশীদিন এখানে স্থায়ী হয় নাই, তারপর পুনরায় নব ব্ৰাহ্মণ্যের ছটা এদেশকে প্ৰদীপ্ত করিয়াছিল। এদেশের লোকেরা যখন যে ভাবটি ধরিয়াছে, তাহার চূড়ান্ত করিয়া ছাড়িয়াছে। পৌণ্ড্র বাসুদেব যে অঞ্চলে কৃষ্ণ-বিদ্বেষের চূড়ান্ত অভিনয় করিয়াছিলেন— তাহার বহুযুগ পরে কে জানিত সেই দেশের মৃত্তিকায়, সেই গঙ্গার উপকূলে, কৃষ্ণ নামের মহিমায় লোকে এমনভাবে মাতিয়া উঠিবে! আমিই 'একমাত্র শঙ্খচক্ৰগদাধর' বলিয়া পৌণ্ড্রক গৰ্ব্ব করিয়াছিলেন এবং বিরুদ্ধবাদীদের জন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, কে জানিত সেই দেশে কৃষ্ণের কীৰ্ত্তিকথা এরূপ ভাবে প্রচারিত হইবে?

জৈন প্রভাব

জৈনেরা জীবে দয়ার অভিনয়ের দূড়ান্ত করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে একদল মাথায় ময়ূরপুচ্ছ লইয়া চলাফেরা করিতেন। পাছে তাঁহাদের পদতলে নিষ্পেষিত হইয়া কোন ক্ষুদ্র কীট নিহত হয়, এই ভয়ে তাহারা সেই ময়ুরপুচ্ছ দিয়া পথ ঝাড়িতে ঝাড়িতে অগ্রসর হইতেন। তাঁহাদের একশ্রেণী প্ৰতিদিন পিপীলিকাকে নিয়মিত ভাবে শর্করা প্ৰদান করেন এবং অন্য একদল বাড়াবাড়ি করিয়া এখনও নগ্ন গাত্রে ছারপোকা ছাড়িয়া দিয়া নিজের দেহের রক্তদ্বারা তাহদের ক্ষুধা নিবারণ করিয়া থাকেন। এক সময়ে স্বয়ং পার্শ্বনাথ এই দেশে বহু বৎসর জৈনধৰ্ম্ম প্রচার করিয়াছিলেন এবং এদেশে-বিশেষ করিয়া সুন্দরবন বিক্রমপুর এবং মানভূম অঞ্চলে-বহু লোক এই ধৰ্ম্ম অবলম্বন করিয়াছিলেন। বহু বঙ্গ-পল্লী হইতে তীর্থঙ্করদের মূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়াছে-এই ধৰ্ম্ম তৎকালে কতটা ব্যাপক হইয়া পড়িয়াছিল-ইহা দ্বারা তাঁহাই বুঝা যায়। জয়নগর-মজিলপুর-নিবাসী স্বদেশের ইতিহাস-উদ্ধারকল্পে নিবেদিত জীবন শ্ৰীযুক্ত কালিদাস দত্ত মহাশয় আমাকে জানাইয়াছেন, তাহার নিবাসপল্লী হইতে ৬/৭ ক্রোশ দূরবর্তী করাঞ্জলী গ্রামে সম্প্রতি একটা পুষ্করিণী-খননকালে প্ৰায় ৬ফিটু উচ্চ এক বিশাল কাল-পাথরের জৈনদিগম্বরসম্প্রদায়ভুক্ত পার্শ্বনাথ মূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। কালিদাসবাবু লিখিয়াছেন, “এরূপ সুন্দর মূর্ত্তি আমি ইতিপূর্বে অন্য কোথায়ও দেখি নাই।” যথাস্থানে ইহার ছবি দেওয়া