পাতা:বেগম রোকেয়া রচনাবলী.pdf/৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 ‘ভারতবাসী ইচ্ছা করিলে কলিকাতাকে ইহা অপেক্ষা অধিক সুন্দর পুষ্পোদ্যানে পরিণত করিতে পারেন।’

 ‘তাঁহাদিগকে অনেক গুরুতর কার্য করিতে হয়, তাঁহারা কেবল পুষ্পবনের উন্নতিকল্পে অধিক সময় ব্যয় করা অনাবশ্যক মনে করিবেন।’

 ‘ইহা ছাড়া তাঁহারা আর কী বলিতে পারেন? জানেন তো অলসেরা অতিশয় বাক্‌পটু হয়!’

 আমার বড় আশ্চর্যবোধ হইতেছিল যে, দেশের পুরুষেরা কোথায় থাকে? রাজপথে শতাধিক ললনা দেখিলাম, কিন্তু পুরুষ বলিতে একটি বালক পর্যন্ত দৃষ্টিগোচর হইল না। শেষে কৌতূহল গোপন করিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘পুরুষেরা কোথায়?’

 উত্তর পাইলাম, ‘যেখানে তাহাদের থাকা উচিত সেইখানে, অর্থাৎ তাহাদের উপযুক্ত স্থানে।’

 ভাবিলাম, তাহাদের ‘উপযুক্ত স্থান’ আবার কোথায়—আকাশে না পাতালে? পুনরায় বলিলাম, ‘মাফ করিবেন, আপনার কথা ভালোমতো বুঝিতে পারিলাম না। তাহাদের ‘উপযুক্ত স্থানের’ অর্থ কী?’

 ‘ওহো! আমার কী ভ্রম!—আপনি আমাদের নিয়মআচার জ্ঞাত নহেন, এ-কথা আমার মনেই ছিল না। এদেশে পুরুষজাতি গৃহাভ্যন্তরে অবরুদ্ধ থাকে।’

 ‘কী! যেমন আমরা অন্তঃপুরে থাকি, সেইরূপ তাঁহারাও থাকেন নাকি?’

 ‘হাঁ, ঠিক তদ্রূপই।’

 ‘বাহ্‌! কী আশ্চর্য ব্যাপার।’ বলিয়া আমি উচ্চহাস্য করিলাম। ভগিনী সারাও হাসিলেন। আমি প্রাণে বড় আরাম পাইলাম;—পৃথিবীতে অন্তত এমন একটি দেশও আছে, যেখানে পুরুষজাতি অন্তঃপুরে অবরুদ্ধ থাকে! ইহা ভাবিয়া অনেকটা সান্ত্বনা অনুভব করা গেল!

 তিনি বলিলেন, ‘ইহা কেমন অন্যায়, যে নিরীহ রমণী অন্তঃপুরে আবদ্ধ থাকে, আর পুরুষেরা মুক্ত, স্বাধীনতা ভোগ করে। কী বলেন, সুলতানা, আপনি ইহা অন্যায় মনে করেন না?’

 আমি আজন্ম অন্তঃপুরবাসিনী, আমি এ-প্রথাকে অন্যায় মনে করিব কিরূপে? প্রকাশ্যে বলিলাম—‘অন্যায় কিসের? রমণী স্বভাবত দুর্বলা, তাহাদের পক্ষে অন্তঃপুরের বাহিরে থাকা নিরাপদ নহে।’

 ‘হাঁ, নিরাপদ নহে ততদিন—যতদিন পুরুষজাতি বাহিরে থাকে। তা কোনো বন্য জন্তু কোনো একটা গ্রামে আসিয়া পড়িলেও তো সে গ্রামখানি নিরাপদ থাকে না। কি বলেন?’

 ‘তাহা ঠিক; হিংস্র জন্তুটা ধরা না-পড়া পর্যন্ত গ্রামটি নিরাপদ হইতে পারে না।’

 ‘মনে করুন, কতকগুলি পাগল যদি বাতুলাশ্রম হইতে বাহির হইয়া পড়ে, আর তাহারা অশ্ব, গবাদি—এমনকি ভালো মানুষের প্রতিও নানাপ্রকার উপদ্রব উৎপীড়ন আরম্ভ করে, তবে ভারতবর্ষের লোকে কী করিবে?’

 ‘তবে তাহারা পাগলগুলিকে ধরিয়া পুনরায় বাতুলাগারে আবদ্ধ করিতে প্রয়াস পাইবে।’

 ‘বেশ! বুদ্ধিমান লোককে বাতুলালয়ে আবদ্ধ রাখিয়া দেশের সমস্ত পাগলকে মুক্তি

■ ১০৫ ■