পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০২
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট

কণ্ঠ আলিঙ্গন করিবার জন্য হাত উঠাইতে চাহিল, হাত উঠিল না! কেবল মুখের দিকে সে চাহিয়া রহিল। উদয়াদিত্য দুই হাতে সুরমার মুখ তুলিয়া ধরিয়া কহিলেন, “সুরমা, সুরমা, তুমি কোথায় যাইবে সুরমা! আমার আর কে রহিল?” সুরমার দুই চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। সে কেবল বিভার মুখের দিকে চাহিল! বিভা তখন হতচেতন হইয়া বোধশূন্য নয়নে সুরমার দিকে চাহিয়া আছে। যেখানে প্রতি সন্ধ্যায় সুরমা ও উদয়াদিত্য বসিয়া থাকিতেন, সম্মুখে সে বাতায়ন উন্মুক্ত। আকাশের তারা দেখা যাইতেছে, ধীরে ধীরে বাতাস বহিতেছে, চারিদিক স্তব্ধ। ঘরে প্রদীপ জ্বালাইয়া গেল। রাজবাটিতে পূজার শাঁক ঘণ্টা বাজিয়া ক্রমে থামিয়া গেল। সুরমা উদয়াদিত্যকে মৃদুস্বরে কহিল, “একটা কথা কও, আমি চোখে ভাল দেখিতে পাইতেছি না।”

 ক্রমে রাজবাটিতে রাষ্ট্র হইল যে, সুরমা নিজ হস্তে বিষ খাইয়া মরিতেছে। রাজমহিষী ছুটিয়া আসিলেন, সকলে ছুটিয়া আসিল! সুরমার মুখ দেখিয়া মহিষী কাঁদিয়া উঠিয়া কহিলেন, “সুরমা, মা আমার, তুই এইখানেই থাক্‌, তোকে কোথাও যাইতে হইবে না। তুই আমাদের ঘরের লক্ষ্মী, তোকে কে যাইতে বলে?” সুরমা শাশুড়ীর পায়ের ধূলা মাথায় তুলিয়া লইল। মহিষী দ্বিগুণ কাঁদিয়া উঠিয়া কহিলেন, “মা তুই কি রাগ করিয়া গেলি রে?” তখন সুরমার কণ্ঠরোধ হইয়াছে, কি কথা বলিতে গেল, বাহির হইল না। রাত্রি যখন চারি দণ্ড আছে, তখন চিকিৎসক কহিলেন, “শেষ হইয়া গেছে!” “দাদা, কি হইল গো” বলিয়া বিভা সুরমার বুকের উপরে পড়িয়া সুরমাকে জড়াইয়া ধরিল। প্রভাত হইয়া গেল, উদয়াদিত্য সুরমার মাথা কোলে রাখিয়া বসিয়া রহিলেন!