পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট
১২১

 তখন রুক্মিণী তাহার ব্রহ্মাস্ত্র বাহির করিল। কাঁদিয়া কহিল, “আমি তােমার কি দোষ করিয়াছি, যাহাতে তােমার চক্ষুশূল হইলাম। তুমিই ত আমার সর্ব্বনাশ করিয়াছ। যে রমণী যুবরাজকে একদিন দেহ প্রাণ বিকাইয়াছে সে আজ ভিখারিণীর মত পথে পথে বেড়াইতেছে এ পোড়া কপালে বিধাতা কি এই লিখিয়াছিল?”

 এইবার উদয়াদিত্যের প্রাণে গিয়া আঘাত লাগিল। সহসা তাহার মনে হইল আমিই বুঝি ইহার সর্ব্বনাশ করিয়াছি। অতীতের কথা ভুলিয়া গেলেন। ভুলিয়া গেলেন যৌবনের প্রমত্ত অবস্থায় রুক্মিণী কি করিয়া পদে পদে তাঁহাকে প্রলােভন দেখাইয়াছে, প্রতিদিন তাঁহার পথের সম্মুখে জাল পাতিয়া বসিয়াছিল, আবর্ত্তের মত তাঁহাকে তাহার দুই মােহময় বাহু দিয়া বেষ্টন করিয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া মুহূর্ত্তের মধ্যে পাতালের অন্ধকারে নিক্ষেপ করিয়াছিল—সে সমস্তই ভুলিয়া গেলেন। দেখিলেন রুক্মিণীর বসন মলিন, ছিন্ন; রুক্মিণী কঁদিতেছে! করুণহৃদয় উদয়াদিত্য কহিলেন, “তােমার কি চাই?”

 রুক্মিণী কহিল, “আমার আর কিছু চাই না, আমার ভালবাসা চাই। আমি ঐ বাতায়নে বসিয়া তােমার বুকে মুখ রাখিয়া তােমার সােহাগ পাইতে চাই। কেন গা, সুরমার চেয়ে কি এ মুখ কালাে? যদি কালােই হইয়া থাকে ত সে তােমার জন্যই পথে পথে ভ্রমণ করিয়া। আগে ত কালো ছিল না।”

 এই বলিয়া রুক্মিণী উদয়াদিত্যের শয্যার উপর বসিতে গেল। উদয়াদিত্য আর থাকিতে পারিলেন না। কাতর হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “ও বিছানায় বসিও না, বসিও না।”

 রুক্মিণী আহত ফণিনীর মত মাথা তুলিয়া বলিল, “কেন বসিব না?”

 উদয়াদিত্য তাহার পথ রােধ করিয়া কহিলেন, “না ও বিছানার কাছে তুমি যাইও না! তুমি কি চাও আমি এখনি দিতেছি।”