পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট
১৩৫

পূর্ব্বদিক হইতে, কারাগারের হৃৎ-স্পন্দন ধ্বনির মত প্রহরীদের পদশব্দ অনবরত কানে আসিতেছে। এক এক প্রহর অতীত হইতে লাগিল, দুর হইতে এক একটা হাঁক শুনা যাইতেছে। আকাশে একটি মাত্র তারা নাই, যে বাঁশঝাড়ের দিকে উদয়াদিত্য চাহিয়া আছেন, তাহা জোনাকীতে একেবারে ছাইয়া ফেলিয়াছে। সে রাত্রে উদয়াদিত্য আর শয়ন করিলেন না, জানলার কাছে বসিয়া প্রহরীদের অবিরাম পদশব্দ শুনিতে লাগিলেন।

 বিভা আজ সন্ধ্যাবেলায় একবার অন্তঃপুরের বাগানে গিয়াছে। প্রাসাদে, বােধ করি অনেক লােক। চারিদিকে দাস দাসী, চারিদিকেই পিসি মাসী, কথায় কথায় “কি হইয়াছে, কি বৃত্তান্ত” জিজ্ঞাসা করে, প্রতি অশ্রুবিন্দুর হিসাব দিতে হয়, প্রতি দীর্ঘ নিশ্বাসের বিস্তৃত ভাষ্য ও সমালােচনা বাহির হইতে থাকে। বিভা বুঝি আর পারে নাই, ছুটিয়া বাগানে আসিয়াছে। সূর্য্য আজ মেঘের মধ্যেই উঠিয়াছে, মেঘের মধ্যেই অস্ত গেল। কখন যে দিনের অবসান হইল, ও সন্ধ্যার আরম্ভ হইল বুঝা গেল না। বিকালের দিকে পশ্চিমের মুখে একটুখানি সােনার রেখা ফুঠিয়াছিল, কিন্তু দিন শেষ হতে না হইতেই মিলাইয়া গেল। আঁধারের উপর আঁধার ঘনাইতে লাগিল। দিগন্ত হইতে দিগন্ত আচ্ছন্ন হইয়া গেল। ঘন-শ্রেণী ঝাউগাছগুলির মাথার উপর অন্ধকার এমনি করিয়া জমিয়া আসিল যে, তাহাদের পরস্পরের মধ্যে একটা ব্যবধান আর দেখা গেল না, ঠিক মনে হইতে লাগিল যেন সহস্র দীর্ঘ পায়ের উপর ভর দিয়া একটা প্রকাণ্ড বিস্তৃত নিস্তব্ধ অন্ধকার দাঁড়াইয়া আছে। রাত হইতে লাগিল, রাজবাড়ির প্রদীপ একে একে নিবিয়া গেল। বিভা ঝাউগাছের তলায় বসিয়া আছে। বিভা স্বভাবতই ভীরু, কিন্তু আজ তাহার ভয় নাই। কেবল, যতই আঁধার বাড়িতেছে, ততই তাহার মনে হইতেছে যেন পৃথিবীকে কে তাহার কাছ হইতে কাড়িয়া লইতেছে; যেন সুখ হইতে, শান্তি হইতে জগৎ সংসারের উপকূল হইতে কে তাহাকে ঠেলিয়া