পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৩৮
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট

একবারাে তুমি খাটে বস নাই। এ দুদিন কি তবে ভূমিতেই আসন করিয়াছ?” বলিয়া বিভা কাঁদিতে লাগিল।

 উদয়াদিত্য ধীরে ধীরে কহিলেন, “খাটে বসিলে আমি যে আকাশ দেখিতে পাই না বিভা! জানলার ভিতর দিয়া আকাশের দিকে চাহিয়া যখন পাখীদের উড়িতে দেখি, তখন মনে হয়, আমারাে একদিন খাঁচা ভাঙিবে, আমিও একদিন ঐ পাখীদের মত ঐ অনন্ত আকাশে প্রাণের সাধে সাঁতার দিয়া বেড়াইব। এ জানাল হইতে যখন সরিয়া যাই, তখন চারিদিকে অন্ধকার দেখি, তখন ভুলিয়া যাই যে, আমার একদিন মুক্তি হইবে, একদিন নিষ্কৃতি হইবে, মনে হয় না জীবনের বেড়ী একদিন ভাঙিয়া যাইবে, এ কারাগার হইতে একদিন খালাস পাইব। বিভা এ কারাগারের মধ্যে এই দুই হাত জমি আছে, যেখানে আসিলেই আমি জানিতে পারি যে, আমি স্বভাবতই স্বাধীন; কোন রাজা মহারাজা আমাকে বন্দী করিতে পারে না। আর ঐ খানে ঐ ঘরের মধ্যে ঐ কোমল শয্যা, খানেই আমার কারাগার।”

 আজ বিভাকে সহসা দেখিয়া উদয়াদিত্যের মনে অত্যন্ত আনন্দ হইল। বিভা যখন তাঁহার চক্ষে পড়িল, তখন তাঁহার কারাগারের সমুদায় দ্বার যেন মুক্ত হইয়া গেল। সে দিন তিনি বিভাকে কাছে বসাইয়া আনন্দে এত কথা বলিয়াছিলেন যে, কারা-প্রবেশের পূর্ব্বে বােধ করি এত কথা কখন বলেন নাই। বিভা উদয়াদিত্যের সে আনন্দ মনে মনে বুঝিতে পারিয়াছিল। জানি না, এক প্রাণ হইতে আর এক প্রাণে কি করিয়া বার্ত্তা যায়, এক প্রাণে তরঙ্গ উঠিলে আর এক প্রাণে কি নিয়মে তরঙ্গ উঠে। বিভার হৃদয় পুলকে পূরিয়া উঠিল। তাহার অনেক দিনের উদ্দেশ্য আজ সফল হইল। বিভা সামান্য বালিকা, উদয়াদিত্যকে সে যে আনন্দ দিতে পারে অনেক দিনের পর ইহা সে সহসা আজ বুঝিতে পারিল। হৃদয়ে সে বল পাইল। এত দিন সে চারিদিকে অন্ধকার