পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট

বুদ্ধিহীন হৃদয়ের বিরুদ্ধে এক দিনের জন্য সমস্ত জগৎকে যেন উত্তেজিত করিয়া দিয়াছিলেন, বিশ্বচরাচর যেন একতন্ত্র হইয়া আমার এই ক্ষুদ্র হৃদয়টিকে মুহূর্ত্তে বিপথে লইয়া গেল। মুহূর্ত্তমাত্র— আর অধিক নয় সমস্ত বহির্জগতের মুহূর্ত্তস্থায়ী এক নিদারুণ আঘাত, আর মুহূর্ত্তের মধ্যে একটি ক্ষীণ হৃদয়ের মূল বিদীর্ণ হইয়া গেল, বিদ্যুদ্বেগে সে ধূলিকে আলিঙ্গন করিয়া পড়িল। তাহার পরে যখন উঠিল তখন ধূলিধূসরিত, ম্লান, সে ধূলি আর মুছিল না, সে মলিনতার চিহ্ন আর উঠিল না। আমি কি করিয়াছিলাম, বিধাতা, যে পাপে এক মুহূর্ত্তের মধ্যে আমার জীবনের সমস্ত শুভ্রকে কালি করিলে? দিনকে রাত্রি করিলে? আমার হৃদয়ের পুষ্প-বনে মালতী ও জুঁই ফুলের মুখ গুলিও যেন লজ্জায় কালাে হইয়া গেল!”

 বলিতে বলিতে উদয়াদিত্যের গৌরবর্ণ মুখ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল, আয়ত নেত্র অধিকতর বিস্ফারিত হইয়া উঠিল, মাথা হইতে পা পর্য্যন্ত একটি বিদ্যুৎশিখা কাঁপিয়া উঠিল। সুরমা হর্ষে, গর্ব্বে, কষ্টে কহিল “আমার মাথা খাও, ওকথা থাক্।”

 উদয়াদিত্য, “ধীরে ধীরে যখন রক্ত শীতল হইয়া গেল সকলি যখন যথাযথ পরিমাণে দেখিতে পাইলাম; যখন জগৎকে উষ্ণ, ঘূর্ণিত মস্তিষ্ক, রক্ত-নয়ন মাতালের কুজ্বাটিকাময় ঘূর্ণমান স্বপ্নদৃশ্য বলিয়া মনে না হইয়া প্রকৃত কার্য্যক্ষেত্র বলিয়া মনে হইল, তখন মনের কি অবস্থা। কোথা হইতে কোথায় পতন! শত সহস্র লক্ষ ক্রোশ পাতালের গহ্বরে, অন্ধ অন্ধতর অন্ধতম রজনীর মধ্যে একেবারে পলক না ফেলিতে পড়িয়া গেলাম। দাদামহাশয় স্নেহভরে ডাকিয়া লইয়া গেলেন; তাঁহার কাছে মুখ দেখাইলাম কি বলিয়া? কিন্তু সেই অবধি আমাকে রায়গড় ছাড়িতে হইল। দাদামহাশয় আমাকে না দেখিলে থাকিতে পারেন না। আমাকে ডাকিয়া পাঠাইতেন। আমার এমনি ভয় করিত যে, আমি কোন মতেই যাইতে পারিতাম না। তিনি স্বয়ং আমাকে ও ভগিনী বিভাকে