পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট

সুখের সময় আমি তোমার কি করিতে পারিতাম? সুখের সময় সুরমা বিলাসের দ্রব্য, খেলিবার জিনিষ। সকল দুঃখ অতিক্রম করিয়া আমার মনে এই সুখ জাগিতেছে যে, আমি তােমার কাজে লাগিতেছি, তােমার জন্য দুঃখ সহিতে যে অতুল আনন্দ আছে, সেই আনন্দ উপভােগ করিতেছি। কেবল দুঃখ এই, তােমার সমুদয় কষ্ট কেন আমি বহন করিতে পারিলাম না?”

 যুবরাজ কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিলেন, “আমি নিজের জন্য তেমন ভাবি না। সকলি সহিয়া গিয়াছে। কিন্তু আমার জন্য তুমি কেন অপমান সহ্য করিবে? তুমি যথার্থ স্ত্রীর মত আমার দুঃখের সময় সান্ত্বনা দিয়াছ, শ্রান্তির সময় বিশ্রাম দিয়াছ, কিন্তু আমি স্বামীর মত তােমাকে অপমান হইতে লজ্জা হইতে রক্ষা করিতে পারিলাম না। তােমার পিতা শ্রীপুর-রাজ আমার পিতাকে প্রধান বলিয়া না মানাতে, আপনাকে যশােহরছত্রের অধীন বলিয়া স্বীকার না করাতে, পিতা তােমার প্রতি অবহেলা দেখাইয়া নিজের প্রধানত্ব বজায় রাখিতে চান। তােমাকে কেহ অপমান করিলে তিনি কানেই আনেন না। তিনি মনে করেন, তােমাকে যে পুত্রবধু করিয়াছেন, ইহাই তােমার পক্ষে যথেষ্ট। এক একবার মনে হয়, আর পারিয়া উঠি না, সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া তােমাকে লইয়া চলিয়া যাই। এত দিনে হয় ত যাইতাম, তুমি কেবল আমাকে ধরিয়া রাখিয়াছ।”

 রাত্রি গভীর হইল। অনেকগুলি সন্ধ্যার তারা অস্ত গেল, অনেকগুলি গভীর রাত্রের তারা উদিত হইল। প্রাকারতোরণস্থিত প্রহরীদের পদশব্দ দূর হইতে শুনা যাইতেছে। সমুদয় জগৎ সুষুপ্ত। নগরের সমুদয় প্রদীপ নিবিয়া গিয়াছে; গৃহদ্বার রুদ্ধ; দৈবাৎ দুএকটা শৃগাল ছাড়া একটি জনপ্রাণীও নাই। উদয়াদিত্যের শয়নকক্ষের দ্বার রুদ্ধ ছিল। সহসা বাহির হইতে কে দুয়ারে আঘাত করিতে লাগিল। শশব্যস্ত যুবরাজ