পাতা:বৌ-ঠাকুরাণীর হাট - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বৌ-ঠাকুরাণীর হাট
৪৯

পদ্ধতি সম্বন্ধে বয়স্কা মাতার সহিত যুবতী দুহিতার নানা বিষয়ে রুচিভেদ আছে, কিন্তু হইলে হয় কি, বিভার কিসে ভাল হয়, মহিষী তাহা অবশ্য ভাল বুঝেন। বিভার মনে মনে ধারণা ছিল, তিনগাছি করিয়া পাতলা ফিরােজ রঙের চুড়ি পড়িলে তাহার শুভ্র কচি হাতখানি বড় মানাইবে;— মহিষী তাহাকে আটগাছা মােটা সােনার চুড়ি ও এক এক গাছা বৃহদাকার হীরার বালা পরাইয়া এত অধিক আনন্দিত হইয়া উঠিলেন যে, সকলকে দেখাইবার জন্য বাড়ির সমুদয় বৃদ্ধা দাসী ও বিধবা পিসীদিগকে ডাকাইয়া পাঠাইলেন। বিভা জানিত যে, তাহার ছােট সুকুমার মুখখানিতে নথ কোন মতেই মানায় না— কিন্তু মহিষী তাহাকে একটা বড় নথ পরাইয়া তাহার মুখখানি একবার দক্ষিণপার্শ্বে একবার বামপার্শ্বে ফিরাইয়া গর্ব্বসহকারে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। ইহাতেও বিভা চুপ করিয়াছিল, কিন্তু মহিষী যে ছাঁদে তাহার চুল বাঁধিয়া দিলেন, তাহা তাহার একেবারে অসহ্য হইয়া উঠিল। সে গােপনে সুরমার কাছে গিয়া তাহার মনের মত চুল বাঁধিয়া আসিল। কিন্তু তাহা মহিষীর নজর এড়াইতে পারিল না। মহিষী দেখিলেন, কেবল চুল বাঁধার দোযে বিভার সমস্ত সাজ মাটি হইয়া গিয়াছে। তিনি স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন সুরমা হিংসা করিয়া বিভার চুল বাঁধা খারাপ করিয়া দিয়াছে;—সুরমার হীন উদ্দেশ্যের প্রতি বিভার চোখ ফুটাইতে চেষ্টা করিলেন;—অনেকক্ষণ বকিয়া যখন স্থির করিলেন কৃতকার্য্য হইয়াছেন তখন তাহার চুল খুলিয়া পুনরায় বাঁধিয়া দিলেন! এইরূপে বিভা তাহার খোঁপা, তাহার নথ, তাহার দুইবাহুপূর্ণ চুড়ি, তাহার এক হৃদয়পূর্ণ আনন্দের ভার বহন করিয়া নিতান্ত বিব্রত হইয়া পড়িয়াছে। সে বুঝিতে পারিয়াছে যে, দুরন্ত আহ্লাদকে কোন মতেই সে কেবলই অন্তঃপুরে বদ্ধ করিয়া রাখিতে পারিতেছে না, চোখে মুখে সে কেবলই বিদ্যুতের মত উঁকি মারিয়া যাইতেছে। তাহার মনে হইতেছে, বাড়ির দেয়ালগুলা পর্য্যন্ত তাহাকে উপহাস করিতে উদ্যত রহিয়াছে।