পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

________________

অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ উপাসনার কথা আছে। ইহাদের মধ্যে ভক্তি অভীষ্টলাভের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায়। কর্ম, জ্ঞান ও যােগের ফল ভক্তির ফলের তুল্য নহে। একমাত্র ভক্তির দ্বারাই কর্মাদির অভীষ্ট ফল লাভ করা যাইতে পারে; কিন্তু কর্মাদি দ্বারা ভক্তির ফল লাভ করা যায় না। ভক্তির ফলে শুধু মুক্তি নহে, ভগবৎ প্রেমও লাভ হয়। বদ্ধজীব ইন্দ্রিয়াদি দ্বারা যে ভক্তির অনুশীলন করে তাহার নাম সাধনভক্তি। সাধনভক্তির সহিত কর্ম-জ্ঞানাদির সংমিশ্রণ। থাকিলে তাহাকে মিশ্রা ভক্তি বলা হয়। মিশ্রা ভক্তিদ্বারা কৃষ্ণপ্রেম লাভ হয় না। কর্মমিশ্র ভক্তিতে ফলভভাগের আকাঙ্ক্ষা এবং জ্ঞানমিশ্র ভক্তিতে মােক্ষলাভের আকাঙ্ক্ষা থাকে। শুদ্ধা সাধনভক্তিতে কৃষ্ণসেবার বাসনা ব্যতীত অন্য কোনও বাসনা থাকে না। শুদ্ধা ভক্তির সাহায্যে কৃষ্ণপ্রেম লাভ হয়। কৃষ্ণের প্রীতির অনুকূলভাবে কায়মনােবাক্যে কৃষ্ণবিষয়ক অনুশীলনের নাম শুদ্ধা ভক্তি। শুদ্ধা সাধনভক্তির চৌষটি অঙ্গের মধ্যে শ্রবণ, কীর্তন, স্মরণ, পাদসেবন, অর্চন, বন্দন, দাস্য, সখ্য ও আত্মনিবেদন, এই নয়টি প্রধান। নবধা ভক্তির মধ্যে নামসংকীর্তনই সর্বশ্রেষ্ঠ। ভগবানের নাম ও ভগবান্ বস্তুতঃ অভিন্ন। নাম অন্যান্য ভজনাঙ্গের অপূর্ণতা পূর্ণ করিতে পারে ; ইহা স্বয়ং ভগবাকেও বশীভূত করিতে পারে। সাধকের চিত্তের অবস্থা অনুসারে সাধনভক্তিকে বৈধী ও রাগাগা, এই দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। ব্রহ্মাণ্ডাধিপতি, কর্মফলদাতা ভগবানকে ভজন না করিলে পরকালে যন্ত্রণা ভােগ করিতে হইবে, ইহা ভাবিয়া যাহারা ভক্তিমার্গ অবলম্বন করেন। তাহাদের ভক্তির নাম বৈধী ভক্তি। শাস্ত্রবিধিই এই ভক্তির প্রবর্তক। বৈধী ভক্তির ফলে সিদ্ধাবস্থায় ভগবানের ঐশ্বর্যাত্মক স্বরূপের সেবাপ্রাপ্তি ঘটে। যাহারা কৃষ্ণের মাধুর্যে প্রলুব্ধ হইয়া তাহার সেবাষােগ্যতা লাভের উদ্দেশ্যে ভজনে প্রবৃত্ত হন তাহাদের ভক্তির নাম রাগানুগা ভক্তি। কৃষ্ণসেবার লােভই ইহার প্রবর্তক। রাগানুগা ভক্তি দ্বারা কৃষ্ণের প্রেম-সেবা লাভ করা যাইতে পারে। রাগানুগার সাধককে অন্তশ্চিন্তিত দেহে লীলাবিলাসী কৃষ্ণের মানসিক সেবা করিতে হয় এবং যথাবস্থিত দেহে বিধিমার্গের সাধকের ন্যায় শ্রবণ-কীর্তনাদির অনুষ্ঠান করিতে হয় । দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য এবং মাধুর্য, এই চারি ভাবের নিত্য পরিকরগণকে লইয়া ব্ৰজে নিরন্তর কৃষ্ণের লীলা চলিতেছে। যে ভাবের সেবার জন্য যে সাধকের চিত্ত প্রলুব্ধ হয় তাহাকে সেই ভাবের পরিকদিগের আনুগত্য স্বীকার করিয়া মানসিক সেবা করিতে হয়। রাগানুগা ভক্তি আনুগত্যময়ী। জীবের দিক হইতে বিচার করিলে মনে হয় যে ভক্তির ভা ১৪________________

অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ পরিপক্ক অবস্থাই প্রেম। এইজন্য প্রেমকে সাধ্য ভক্তি বলা হয়। বস্তুতঃ কৃষ্ণপ্রেম সাধ্য বস্তু নহে, উহা নিত্যসিদ্ধ। উহা ভগবানের স্বরূপশক্তির অন্তর্গত হলাদিনীশক্তির বৃত্তিবিশেষ। ভগবানের স্বরূপশক্তির বাহিরে উহার অবস্থান নাই। সুতরাং প্রাকৃত জীবের প্রাকৃত মনে উহার অবস্থান | সম্ভব নহে। শুদ্ধ সাধনভক্তির ফলে চিত্ত বিশুদ্ধ হইলে তথায় প্রেমের আবির্ভাব হয় মাত্র। প্রেমের শক্তি অসাধারণ। প্ৰেম ভগবানকে দেখাইতে এবং বশীভূত করিতে পারে। কৃষ্ণ অপেক্ষা আপন জীবের আর কেহ নাই। জীব স্বরূপতঃ কৃষ্ণের সেবক ; কৃষ্ণসেবার বাসনাই তাহার স্বরূপগত ধর্ম। কৃষ্ণের কৃপায় মায়ার প্রভাব বিদূরিত হইলে জীবের এই সম্বন্ধজ্ঞান ও সেবাসনা আপনা-আপনি স্ফুরিত হইতে থাকে। প্রথমাবস্থায় এই সেবাসনা প্রাকৃত মনের বৃত্তিরূপেই আবির্ভূত হয়, কিন্তু যখন ভগবৎকৃপাপুষ্ট সাধনের ফলে প্রাকৃত মন শুদ্ধসত্ত্বের সহিত তদাত্ম প্রাপ্ত হয় তখন এই সেবাবসিনাও উহার সহিত তাদাত্ম প্রাপ্ত হইয়া অপ্রাকৃত হইয়া যায়। এই অপ্রাকৃত সেবাসনা যখন শ্রীকৃষ্ণনিক্ষিপ্ত হলাদিনীর | বৃত্তিবিশেষের সহিত মিলিত হয় তখন তাহাকে প্রেম আখ্যা দেওয়া হয়। পরম কারুণিক কৃষ্ণ সর্বদাই তঁাহার | লাদিনীর বৃত্তিবিশেষকে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত করিতেছেন। প্রাকৃত চিত্ত মলিনতাবশতঃ উহা গ্রহণ করিতে পারে না। বিশুদ্ধ চিত্তে উহার আবির্ভাব হয়। কিন্তু উহা একই সময়ে পূর্ণতমরূপে আবির্ভূত হয় না, বিভিন্ন স্তরে প্রকটিত হয়। প্রেমের আবির্ভাবে শ্রীকৃষ্ণে অত্যন্ত মমতা জন্মে ; ফলে শ্রীকৃষ্ণের ভগবত্তা সম্বন্ধে জ্ঞান তিরােহিত হয়। এই জগতে সখা, পুত্র, পতি প্রভৃতির সহিত মানুষের সম্বন্ধ যত ঘনিষ্ঠ, নিত্যধামে কৃষ্ণের সহিত তাহার পরিকরদের সম্পর্ক তদ| পেক্ষাও ঘনিষ্ঠ। ভক্ত কখনও নিজের সুখের লেশমাত্র কামনা করেন না; তিনি কৃষ্ণকে সুখী করিতেই ব্যস্ত। কৃষ্ণচিন্তা ভিন্ন তাহার চিত্তে আর কিছু নাই। তাহার প্রেমবন্ধন ছিন্ন হওয়ার কারণ উপস্থিত হইলেও ছিন্ন হয় না। প্রেমের গাঢ়তম অবস্থায় ভক্ত কৃষ্ণকে সুখ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বেদ, ধর্ম, স্বজন, সমাজাদি ত্যাগ করিয়া স্বীয় অঙ্গ দ্বারাও কৃষ্ণের সেবা করিতে যত্নবান হন। ব্রজের গোপীগণের মধ্যেই প্রেমের সর্বাধিক বিকাশ। গােপীগণ শ্রীরাধার কায়বহরূপ। শ্রীরাধার প্রেমই সর্বাতিশায়ী। বহুকান্তা ব্যতীত উজ্জ্বলরসবৈচিত্রীর উল্লাস হয় না বলিয়া শ্রীরাধা অসংখ্য গােপীরূপে আত্মপ্রকাশ করিয়াছেন।

সাধকের চিত্তে সর্বপ্রথম প্রেমের যে স্তরের আবির্ভাব হয়, তাহার নাম প্রেমাঙ্কুর, ভাব বা রতি। রতির পরের

২৫