পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ
অচিরবতী
যাহাকে জগৎ বলি, তাহা পরব্রহ্মের মায়াশক্তির পরিণাম। শাস্ত্রে যে সকল ভগবামের কথা বলা হইয়াছে সেইসকল ধাম পরব্রহ্মের চিচ্ছক্তির বিলাস। পরব্রহ্মের পরিকরগণও তাহার চিচ্ছক্তি বা স্বরূপশক্তির মূর্ত বিগ্রহ। যেহেতু জীবজগদাদি সমস্তই পরব্রহ্মের শক্তি সেই হেতু শক্তির সহিত শক্তিমানের যে সম্বন্ধ বিদ্যমান জীব-জগদাদির সহিত পরব্রহ্মেরও সেই সম্বন্ধ স্বীকার্য। অগ্নির সহিত দাহিকাশক্তির ন্যায় পরব্রহ্মের সহিত তাহার শক্তি নিত্য অবিচ্ছেদ্যভাবে বিদ্যমান। এই প্রকার নিত্য অবিচ্ছেদ্য শক্তির নাম স্বাভাবিক শক্তি। স্বাভাবিক শক্তি আগন্তুক শক্তি হইতে পৃথক। অগ্নিদাত্ম প্রাপ্ত লৌহখণ্ডের দাহিকাশক্তি স্বাভাবিক নহে, আগন্তুক। ইহা সকল সময়ে লৌহখণ্ডে থাকে না। কিন্তু পরব্রহ্মের শক্তিসমূহ সর্বদাই পরব্রহ্মে থাকে। কস্তুরীর গন্ধকে যেমন কস্তুরী হইতে পৃথক করা যায় না, দাহিকাশক্তিকে যেমন অগ্নি হইতে পৃথক করা যায় না, সেইরূপ পরব্রহ্মের শক্তিকেও পরব্রহ্ম হইতে পৃথক করা যায় না। শক্তিকে বাদ দিয়া শুধু শক্তিমানকে বস্তু বলা চলে না; শক্তিমানকে বাদ দিয়া শুধু শক্তিকেও বস্তু বলা যায় না। শক্তি এবং শক্তিমান, এই উভয়ের মিলিত স্বরূপই বস্তুর স্বরূপ। বস্তুটি বিশেষ্য, শক্তিসমূহ তাহার বিশেষণ। স্বাভাবিক বিশেষণযুক্ত বিশেষ্যই বস্তু। আনন্দস্বরূপ পরব্রহ্ম বিশেষ্য, স্বরূপশক্তি, তটস্থা শক্তি, মায়া শক্তি প্রভৃতি তাহার বিশেষণ। পরব্রহ্ম শক্তিমান আনন্দ। প্রশ্ন হইতে পারে যে, বস্তু বলিলেই যদি বিশেষ্য ও বিশেষণের, শক্তিমান ও শক্তির। অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ বুঝায়, পরব্রহ্ম বলিলেই যদি শক্তিমান আনন্দকে বুঝায়, তাহা হইলে পৃথকভাবে শক্তির নাম উল্লেখ করার প্রয়ােজন কি? জীবগােস্বামী তাহার সর্বসম্বাদিনীতে এই প্রশ্নের উত্তর প্রদান করিয়াছেন। ( সর্বসম্বাদিনী, পৃ ৩৮)-কোনও কোনও ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, মাদির প্রভাবে বস্তুর শক্তি স্তম্ভিত হইলেও বস্তুটি বিনষ্ট হয় না। সাময়িকভাবে অগ্নির দাহিকাশক্তি স্তম্ভিত হইলেও অগ্নিকে বিদ্যমান থাকিতে দেখা যায়; এইরূপ ক্ষেত্রে শক্তির অনুভবের অভাব হইলেও শক্তিমানের অনুভব থাকে। সুতরাং শক্তিকে শক্তিমান হইতে পৃথক নামে অভিহিত করাই যুক্তিসংগত। শক্তি ও শক্তিমানের অভেদ অবশ্যই স্বীকার্য। যেখানে অগ্নি আছে সেখানে দাহিকা শক্তিও আছে, যেখানে কস্তুরী আছে সেখানে তাহার গন্ধও আছে; তথাপি শক্তি ও শক্তিমানকে সর্বতােভাবে অভিন্ন বলা যায় না, কারণ শক্তিমানের বাহিরেও অনেক সময়ে শক্তির প্রভাব অনুভূত হয়।
অগ্নির বহির্দেশেও দাহিকা শক্তি বা তাপ অনুভূত হয়; দূর হইতেও কস্তুরীর গন্ধ পাওয়া যায়। পরব্রহ্ম প্রত্যক্ষীভূত হইলেও তাহার শক্তির আভাস অনুভূত হয়। সুতরাং শক্তি ও শক্তিমানের ভেদও অস্বীকার করা যায় না, অভেদও অস্বীকার করা যায় না। উহাদের মধ্যে কেবল অভেদ স্বীকার করিলে এক অসমাধেয় সমস্যার উদ্ভব হয়। শক্তি যদি শক্তিমানের সহিত সর্বতােভাবে অভিন্ন হয় তাহা হইলে শক্তিমানের বাহিরে তাহার অনুভূতি হয় কিরূপে? শক্তিমানের সহিত শক্তির ভেদ আছে বলিয়াই শক্তিমানের বাহিরেও কখনও কখনও শক্তি অনুভূত হইয়া থাকে। শক্তিমান ও শক্তির মধ্যে ভেদ আছে সত্য, কিন্তু ইহাকে সম্পূর্ণ ভেদ বা কেবল ভেদ বলা যায় না। পর ব্রহ্ম ও তাহার শক্তি দুইটি পৃথক পদার্থ নহে। দুইটিকে। পৃথক পদার্থ মনে করিলে পরব্রহ্মের অদ্বয়ত্ব রক্ষা করা যায় না। এইজন্য বঙ্গীয় বৈষ্ণবাচার্যগণ পরব্রহ্মের সহিত তাহার শক্তির যুগপৎ ভেদ ও অভেদ স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু ভেদ ও অভেদ কিভাবে যুগপং অবস্থান করে তাহা বুদ্ধিগম্য নহে। জগতের প্রত্যেক বস্তুর সহিত উহার শক্তির এইরূপ ভেদ ও অভেদ সম্বন্ধ বিদ্যমান। বিষ্ণুপুরাণে উক্ত হইয়াছে যে, সমস্ত ভাববস্তুর শক্তিই অচিন্ত্যজ্ঞানগােচর ( বিষ্ণুপুরাণ ১/৩২)। শর্করার মিষ্টত্ব, যবক্ষারের তিক্ততা, অগ্নির উত্তাপ প্রভৃতি অস্বীকার করিবার উপায় নাই। কিন্তু শর্করা মিষ্ট কেন, যবক্ষার তিক্ত কেন, অগ্নি জ্বালাময় কেন, এই সকল প্রশ্নের কোনও সমাধান নাই। বিচার-বুদ্ধি দ্বারা হেতু নির্ণয় করা অসম্ভব হইলেও যাহার অস্তিত্ব অস্বীকার করা যায় না, তাহাকেই অচিন্ত্যজ্ঞানগােচর বস্তু বলা হয়। শক্তি ও শক্তিমানের মধ্যে যে যুগপং ভেদাভেদসম্বন্ধ রহিয়াছে তাহাও এইরূপ অচিন্ত্য পদার্থ। উভয়ের ভেদ বা অভেদ কোনওটিই অস্বীকার করা যায় না, অথচ পরস্পরবিরােধী উভয়ের যুগপং অবস্থান কোনও প্রকার যুক্তিতর্ক দ্বারা প্রমাণ করা যায় না। এইজন্য শক্তি ও শক্তিমানের সম্বন্ধটিকে অচিন্ত্যভেদাভেদসম্বন্ধ বলা হইয়াছে।

বঙ্গীয় বৈষ্ণবাচার্যগণ শাস্ত্রানুগতভাবে সমম্বয়ের দৃষ্টি অবলম্বন করিয়া যে অভিনব দার্শনিক তত্ত্বের সন্ধান দিয়াছেন সেই অচিন্ত্যভেদাভেদতত্ত্ব ভারতীয় দর্শনের এক অমূল্য সম্পদ।

সুধীন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্তী
অচিরবতী উত্তর প্রদেশের অযােধ্যা অঞ্চলে প্রবাহিত রাপ্তি নদীর প্রাচীন নাম। কোশল দেশের রাজধানী
২৭