পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

________________

অজ্ঞাবাদ অবিশ্বাসী নাস্তিক এবং উহাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে জ্ঞানের দাবি করেন জ্ঞানবাদী (gnostic)। এই দুই পর পরবিরুদ্ধ মতবাদ পরিহার করিয়া মধ্যম পন্থা অবলম্বন করেন অজ্ঞাবাদী (agnostic)। অতীন্দ্রিয় তত্ত্ব সম্বন্ধে অজ্ঞাবাদী কিছু স্বীকারও করেন না, আবার অস্বীকারও করেন না। অজ্ঞাবাদের মূলে আছে প্রত্যক্ষৈক প্রমাণবাদ (empiricism)- এখানে প্রত্যক্ষ’ শব্দে কেবল ইন্দ্রিয়জন্য প্রত্যক্ষই। বুঝিতে হইবে। প্রত্যক্ষৈকপ্রমাণবাদী বলেন যে আমাদের সকল জ্ঞানের উৎস হইল ঐন্দ্রিয়জ্ঞান। কিন্তু যদি ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানই আমাদের একমাত্র সম্বল হয় তাহা হইলে আমরা ইন্দ্রিয়াতীত তত্ত্ব সম্বন্ধে কোনও দিনই কিছু জানিতে পারিব না। এইভাবে প্রত্যক্ষৈকপ্রমাণবাদের এক ধারা। অজ্ঞাবাদে পরিণত হইয়াছে, অন্য ধারা পরিণত হইয়াছে। অবিশ্বাসবাদে। অনেকে মনে করেন যে ভারতীয় দর্শনসমূহের মধ্যে প্রাচীন বৌদ্ধদর্শন অজ্ঞাবাদের সমর্থক। কিংবদন্তী আছে যে, বুদ্ধদেবকে যখন আত্মা ও জগৎসংসার সম্বন্ধে দশটি আধিবিদ্যক প্রশ্ন করা হয় তখন তিনি নীরব ছিলেন। এইগুলি ‘দশ অব্যক্তানি’ নামে অভিহিত। কিন্তু বুদ্ধদেব স্বয়ং কতদূর অজ্ঞাবাদী ছিলেন সে সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ আছে। পাশ্চাত্য দর্শনে agnosticism বা অজ্ঞাবাদ পদটি আধুনিক কালে প্রবর্তন করেন টি. এইচ. হাক্সলি ( T. H. Huxley)। ১৮৬৯ খ্রীষ্টাব্দে অধুনালুপ্ত Metaphysical Society-র অধিবেশনে বিভিন্ন সদস্য যখন তাহাদের নিজ নিজ মতবাদ ব্যাখ্যা করিতেছিলেন তখন হাক্সলি বলেন যে, তাহার নিজস্ব মতবাদ হইল agnosticism (a =ন, gnosticism = জ্ঞানবাদ)। প্রাচীন জ্ঞানবাদী (gnostic) যেমন অতীন্দ্রিয় তত্ত্ব সম্বন্ধে জ্ঞানের দাবি করিতেন, হাক্সলি সেইরূপ সবিনয়ে তাহার অজ্ঞতার কথা নিবেদন করেন। সম্ভবতঃ এ বিষয়ে তিনি হ্যামিল্টন (Hamilton) -এর রচনার দ্বারা প্রভাবিত হইয়াছিলেন। হাক্সলি মনে করিতেন যে, হিউম ( Hume ) ও কান্ট ( Kant) তাহার স্বদলীয়। হিউমের দর্শন প্রত্যক্ষৈকপ্রমাণবাদের চরম নিদর্শন। পূর্বেই বলিয়াছি ইহা শেষ পর্যন্ত হয় সন্দেহবাদে না হয় অবিশ্বাসবাদে পরিণত হয়। কান্ট হার Critique of Pure Reason গ্রন্থে অতীন্দ্রিয় তত্ত্বের জ্ঞান, যাহার অপর নাম আধিবিদ্যক জ্ঞান, অসম্ভব বলিয়া মনে করিয়াছেন। তিনি বলেন যে, যে সকল মূল প্রত্যয় দ্বারা আমাদের জ্ঞান গঠিত, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের বাহিরে ইন্দ্রিয়াতীত তত্ত্বের ক্ষেত্রে তাহাদের কোনও অবকাশ নাই। সুতরাং ঐ সকল তত্ত্ব চিরদিনই ভা ১০৫

________________

অরাবাদ অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয় থাকিয়া যাইবে । তাহার মতে অজ্ঞেয় অতীন্দ্রিয় পদার্থ দুই প্রকার। উপরি-উক্ত প্রত্যয়গুলি যখন স্বমহিমায় যাবৎ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পদার্থের সমাহার করিয়া ইন্দ্রিয়গ্রাহের এক অপরূপ চরমােৎকর্ষ চিন্তা করে এবং স্বভাবতঃ তাহা বিশ্বাস করে, তখন সেই চরম উৎকৃষ্ট রূপটি জ্ঞানপরিধির বাহিরে থাকে, কারণ ঐ রূপটি ইন্দ্রিয়ের নিকট ধরা পড়িতে পারে না এবং যাহা ইন্দ্রিয়ের নিকট ধরা পড়িতে পারে না, কান্টের মতে তাহা অজ্ঞেয়। আত্মা, ঈশ্বর, জগতের আদি কারণ প্রভৃতি প্রচলিত অতীন্দ্রিয় পদার্থগুলি এই জাতীয়। দ্বিতীয় এক প্রকার অতীন্দ্রিয় পদার্থ আছে, যাহার নাম thing-in-itself। কান্ট মনে করেন যে দেশকালরূপ আকারে আকারিত রূপরসগন্ধস্পশাদি ইন্দ্রিয়ােপাত্ত গুলি আম-নিরপেক্ষ নহে, কারণ তাহার মতে ইন্দ্রিয়ােপাত্ত এবং দেশকালরূপ আকার, উভয়েই আমা-সাপেক্ষ। অথচ আমি বিশ্বাস না করিয়া থাকিতে পারি না যে, যখন আমি বৃক্ষলতাদি বস্তুগুলি দেখি তখন আম-নিরপেক্ষ কিছু-একটা পদার্থ নিশ্চয়ই আছে। যেহেতু স্বরূপে এই পদার্থ আমার ইন্দ্রিয়ের নিকট ধরা পড়ে না এবং যেহেতু স্বরূপে এই পদার্থ দেশকালরূপ আকারে আকারিত হয় না, অতএব উহ। অজ্ঞেয়। ইহাই হইল কান্টের অজ্ঞাবাদ। কান্ট মনে করেন যে অতীন্দ্রিয় পদার্থগুলি জ্ঞানলভ্য না হইলেও আমরা ইহাদের স্বীকার করি এবং ইহাদের কয়েকটি আমরা কর্মমার্গে এবং দুই-একটি রসােপলব্ধিমার্গে ধরিতে পারি। আমাদের দেশেও অনেক বৈষ্ণব দার্শনিক এই জাতীয় কথা বলেন বিশ্বাসে মিলয়ে কৃষ্ণ, তর্কে বহুদূর। হ্যামিল্টন বলেন যে চরমতত্ত্ব (absolute) হইলেন অজ্ঞেয়। জগতের কোনও কিছু জানিতে হইলে উহাকে অন্য বস্তুর সহিত সম্বন্ধযুক্তভাবে জানিতে হয়। কিন্তু চরমতত্ত্ব হইলেন ‘একমেবাদ্বিতীয়, তিনি সকল সম্বন্ধের বন্ধনমুক্ত ; সুতরাং তাহাকে জানার অর্থ তাহাকে আবার বন্ধনযুক্ত করা। যেহেতু ইহা স্ববিরােধী, অতএব বলা যাইতে পারে যে, আমাদের জ্ঞানলাভের সাধারণ পদ্ধতি অনুসারে চরমতত্ত্ব অজ্ঞেয়। হার্বার্ট স্পেন্সার বিজ্ঞানের (science) পূজারী হইয়াও | শেষকালে স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন যে, সমগ্র | বিশ্ব ব্যাপিয়া এক বিরাট শক্তির কার্য চলিতেছে। তবে | তিনি ইহাও বলিলেন, আমরা জানি যে এই শক্তি আছে কিন্তু ইহা কি, তাহা আমরা জানি না ; অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যে শক্তির প্রকাশ সেই শক্তি আমাদের নিকট অজ্ঞেয়। দার্শনিক মতবাদ হিসাবে অজ্ঞাবাদকে সম্পূর্ণরূপে

৩৩