পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
অথর্ববেদ
অদ্ভুত রামায়ণ

ঋগবেদের পরে অথর্ববেদ সংকলিত হইয়াছিল। কিন্তু। সংকলিত মন্ত্রগুলি যে সবই ঋগবেদ অপেক্ষা অর্বাচীন এমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। এই বিষয়ে ভাষার তারতম্যগত প্রমাণ পৌর্বাপর্যনির্ণয়ের পক্ষে যথেষ্ট বলিয়া স্বীকৃত হয় না।

অথর্ববেদের বহু মন্ত্রেরই মুখ্য বিনিয়োেগ গৃহকর্মে, শ্রৌতযজ্ঞে উপযােগিতা নাই বলিলেই চলে। এই বেদের স্বার্থকেন্দ্রিক মন্ত্রগুলির মধ্য দিয়া সাধারণ মানুষের সহজাত আশা ও আকাঙ্ক্ষা পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ পাইয়াছে। ‘শান্ত’ ও ‘ঘের’ এই দুই প্রকার কর্মসিদ্ধির উদ্দেশ্যে দেবতা ওষধি প্রভৃতির আবাহন ও প্রসাদন অথবমন্ত্রের লক্ষ্য। অর্থলাভ, লােগনাশ, রাষ্ট্রিক সমৃদ্ধি, পারিবারিক সম্প্রীতি, ভূতনিবারণ প্রভৃতি শান্তকর্ম। এইগুলি শান্তিকপৌষ্টিকের অন্তর্গত আভদয়িক কৃত্য। শত্রুবিনাশ, পররাষ্ট্রের উংসাদন, প্রতিপক্ষপীড়ন, বশীকরণ, ভূতাবেশন প্রভৃতি ঘাের কর্ম। এই গুলি যাতুবিদ্যার অন্তর্গত আভিচারিক কৃত্য। কৃত্যাপ্রতিহরণ’ নামে আরও এক শ্রেণীর মন্ত্র পাওয়া যায়। উহার বিনিয়োেগ হয় শত্ৰুকৃত অভিচারের প্রতিষেধকল্পে। আঙ্গিরসকল্পে’ দশ প্রকার অথর্বণিক কর্মের উল্লেখ আছে- শান্তিক, পৌষ্টিক, বশীকরণ, স্তম্ভন, মােহন, দ্বেষণ, উচ্চাটন, মারণ, আকর্ষণ ও বিদ্রাবণ। আথর্বণিক দশকর্মের সঙ্গে তন্ত্রোক্ত ষটুকর্মের বেশ মিল দেখা যায়। এই সকল আভদয়িক ও আভিচারিক কর্মের উপযােগী মন্ত্র অন্য বেদে অল্প, অথর্ববেদে অধিক। ইহা ছাড়া বিবাহ, গর্ভাধান, পিতৃমেধ প্রভৃতি নিত্যানুষ্ঠেয় কর্মের মন্ত্রও এই বেদে আছে।

সাধারণ লােকের প্রয়ােজনে সংকলিত অথর্ববেদ নানাদিক হইতে তাৎপর্যপূর্ণ। এই বেদের ভূমিসূক্তে (১২.১) বৈদিক ঋষি বসুন্ধরাকে সর্বপ্রথম জননী বলিয়া অভিহিত করিয়াছিলেন— ‘মাতা ভূমিঃ পুত্রো অহং পৃথিব্যা’। এই বেদের আয়ুষ্য মন্ত্র ও ভৈষজ্য মন্ত্রে ভারতীয় আয়ুর্বিজ্ঞান প্রথম রূপ পরিগ্রহ করিয়াছিল। এই প্রসঙ্গে যে নানারূপ ওষধির নাম এবং বিভিন্ন শারীর সংস্থানের উল্লেখ আছে তাহাই আয়ুর্বেদশাস্ত্রের ভিত্তিভূমি বলিয়া স্বীকৃত। অথর্ববেদের ‘রাজকর্ম পর্যায়ের মন্ত্র প্রকরণে রাজার নির্বাচন, অভিষেক। ও গুণাবলী এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সম্পর্কে কিছু গভীরার্থ। উক্তি পরিলক্ষিত হয়। এইরূপে এই বেদের বিভিন্ন প্রকরণের মন্ত্ৰসমূহ লৌকিক ও ঐহিক বিষয়ে বেদাধ্যায়ীর আগ্রহ সৃষ্টি করিয়া থাকে।

অপর দিকে অথর্ববেদে আধ্যাত্মিক মন্ত্রের সংখ্যাও কম। নয়। এক পরম তত্ত্বেই যে বিশ্বের প্রতিষ্ঠা’ তাহা এই
বেদের নানা মন্ত্রে বারংবার ঘােষিত হইয়াছে। ব্রহ্মচারী, বেন, স্কন্ত, অনড়ান, রােহিত, উচ্ছিষ্ট, কাল, প্রাণ, পার্ষি, সলিল প্রভৃতি বিষয়ে অথর্ববেদের সূক্তগুলি সৃষ্টিরহস্য ও আত্মতত্ত্বের গুরুত্বময় ভাবনা বলিয়া বিবেচিত হয়। সুপ্রসিদ্ধ ব্রাত্যকাণ্ডের (পঞ্চদশ কাণ্ড) ব্রাত্যগণকে অনেকে নিগূঢ় অধ্যাত্মরহস্যের প্রতীকরূপে ব্যাখ্যা করিয়া থাকেন।

অথর্ববেদের এক নাম ব্ৰহ্মবেদ। গােপথব্রাহ্মণে নির্দেশ আছে যে, ব্রহ্মা নামে ঋত্বিক অথর্ববিদ্যায় পারঙ্গম হইবেন। তদনুসারে ব্রহ্মার সহিত সম্পর্ক হেতু ব্ৰহ্মবেদ সংজ্ঞাটির উৎপত্তি হইয়াছে ধরিয়া লওয়া যায়। ব্ৰহ্ম শব্দের এক অর্থ অভিচার মন্ত্র, অপর অর্থ বিশ্বের মূল তত্ত্ব। এই উভয়রূপ ব্ৰহ্মই অথর্ববেদের প্রতিপাদ্য। সুতরাং সকল প্রকারেই অথর্ববেদ ব্ৰহ্মবেদ। বস্তুতঃ এই বেদে আভদয়িক ও আভিচারিক মন্ত্রের সঙ্গে আধ্যাত্মিক মন্ত্রের একটা নিবিড় সংমিশ্রণ ঘটিয়াছে। এই দিক দিয়া অথর্ববেদ একাধারে ঐহিক ও পারমার্থিক ঋদ্ধির অনুকূল। আঙ্গিরসকল্পের মতে এই বেদে সংসারীর ভােগ এবং সন্ন্যাসীর মােক্ষ এই উভয়েরই সন্ধান পাওয়া যায় যত্রহি রাগিণাং ভুক্তির্যত্র মুক্তিররাগিণম্।

দুর্গামােহন ভট্টাচার্য

অদিতি দক্ষ প্রজাপতির কন্যা ও কশ্যপের স্ত্রী। সবিতা, বিষ্ণু, সূর্য, ত্বষ্টা, বরুণ, ধাতা, অর্যমা, রুদ্র, পূষা, মিত্র, বিবস্বান্ এবং ভগ - এই দ্বাদশ দেবতার মাতা বলিয়া ইনি দেবমাতা নামে খ্যাত। ইন্দ্র ইহাকে সমুদ্রমন্থনলব্ধ কুণ্ডল দান করেন। পারিজাত লাভের জন্য ইন্দ্র ও কৃষ্ণের যে বিবাদ হয় অদিতি তাহা মীমাংসা করিয়া দেন। ইহার ভগ্নী দিতি হইতে দৈত্যকুলের জন্ম হয়।

অদ্ভুত রামায়ণ বাল্মীকি-বিরচিত রামায়ণের অর্বাচীন পরিশিষ্ট। ইহার অন্য নাম ‘অদ্ভুতােত্তর কাণ্ড। ভরদ্বাজ মুনির নিকট ইহ বাল্মীকি-কর্তৃক কথিত। অধ্যায় সংখ্যা ২৭, শ্লোক সংখ্যা ১৩৫৯। এই গ্রন্থে সীতাকে রাবণের রানী মন্দোদরীর কন্যা রূপে উল্লেখ করা হইয়াছে। এখানে সীতা মূল প্রকৃতি বা শক্তি রূপে বর্ণিত। পুষ্কর দ্বীপে সহস্ৰস্কন্ধ রাবণের সহিত যুদ্ধে রামচন্দ্র মূৰ্হিত হইয়া পড়িলে, সীতা প্রচণ্ড মূর্তি ধারণ করিয়া রাবণ বধ করেন। সীতার মহিমা, সহস্রনাম স্তোত্র ও অন্যান্য বহু বিষয়ের সহিত এই গ্রন্থে সাংখ্য ও বেদান্ত -সম্মত আত্মতত্ত্বজ্ঞানও বর্ণিত হইয়াছে। এই গ্রন্থ কাশ্মীরের শাক্ত সমাজে সমাদৃত।
৪৩