পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/৭০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
অদ্বৈতবাদ
অদ্বৈতবাদ

মঙ্গল’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচিত হইয়াছে, কিন্তু ঐ গ্রন্থগুলি যথেষ্ট প্রামাণিক নহে।

বিমানবিহারী মজুমদার
অদ্বৈতবাদ অদ্বৈতবাদ উপনিষদে বর্ণিত জীবাত্মা ও ব্রহ্মের অভেদ কল্পনার উপর প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন ভারতের অন্যতম প্রধান দার্শনিক মত। বৃহদারণ্যক প্রভৃতি প্রধান প্রধান উপনিষদের মতে সমগ্র বাহ্যিক জগতের বৈচিত্র্যের মধ্যে একটি স্থির শাশ্বত মূলতত্ত্ব রহিয়াছে। এই তত্ত্ব অনাদি, অনন্ত, নিত্য ধ্রুব শাশ্বত হইলেও স্বীয় বিশেষ শক্তি দ্বারা এই পাঞ্চভৌতিক জগৎ সৃষ্টি পূর্বক স্বয়ং তাহাতে প্রবেশ করিয়া তাহাকে সত্তার আভাস দান করিয়াছেন। এই সমস্ত বস্তুতে অস্ত তত্ত্বই সচ্চিদানন্দ স্বরূপ ব্ৰহ্ম। আবার এই সচ্চিদানন্দ স্বরূপই স্বীয় বুদ্ধমুক্তস্বভাবকে আবৃত করিয়া বদ্ধজীবরূপে জগৎ ভােগার্থে প্রকাশমান। অতএব একটি অখণ্ড আত্মচৈতন্যই জগৎপ্রপঞ্চরূপে ভােগের বিষয় ও অসংখ্য জীবরূপে ভােগের কর্তা। জীবাত্মা ও পরমাত্মা, জীব ও জগৎ এবং জগৎ ও পরমাত্মায় যে কোনও ভেদই। নাই, ইহাই অদ্বৈতবাদের যথার্থ বক্তব্য তত্ত্ব। দ্বৈতের অভাবই অদ্বৈত। এই মতে সত্য এক অদ্বিতীয় ও চিরন্তন। এই মতকে উপজীব্য করিয়া প্রথম গৌড়পাদাচার্য মাক্য উপনিষদের কারিকা রচনা করেন। তাহার মতে স্বীয় মায়াশক্তি দ্বারা পরচৈতন্য জগদ রূপ মায়ার বিলাস সৃষ্টি করিয়াছেন। প্রকৃতপক্ষে জগতের নিজস্ব স্বাধীন সত্তা নাই। মায়াকল্পিত জীব মায়াকল্পিত শরীর ধারণ করিয়া মায়াকল্পিত জগৎসংসারে বিচরণ করিতেছে। পারমার্থিক দৃষ্টিতে জীব বা জগতের উৎপত্তিও নাই ধ্বংসও নাই। গৌড়পাদাচার্যের প্রভাবে শংকরাচার্য অদ্বৈততত্ত্ব দৃঢ়। প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য প্রধান প্রধান উপনিষৎ ও ব্যাসরচিত বেদান্তসূত্রের উপরে ভাষ্য রচনা করেন। এতদব্যতীত বিভিন্ন স্থানে মঠস্থাপন দ্বারা অদ্বৈতবাদচর্চার পথ সুগম করিয়া তিনি মতটি এমন সুপ্রতিষ্ঠিত করেন যে পূর্বচর্চা থাকা সত্ত্বেও তাহাকেই অদ্বৈতবাদের স্থাপক বলিয়া গ্রহণ করা হয়। শংকরাচার্য ৭০০ খ্ৰীষ্টাব্দ হইতে ৮০০ খ্ৰীষ্টাব্দ মধ্যে আবিভূত হইয়াছিলেন। ইনি দাক্ষিণাত্যের অধিবাসী ও পিতার নাম শিবগুরু যজুর্বেদী। শংকরাচার্য আত্মার একত্ব স্থাপন করিবার জন্য জগতের মিথ্যাত্ব প্রতিপন্ন করিয়াছেন। এই জগৎমিথ্যাত্ব মতটি মায়াবাদের উপর স্থাপিত। আত্মার অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোনও মতভেদ নাই, সমস্ত তর্ক আত্মার স্বরূপ সম্বন্ধে। শংকরাচার্য পরমতখণ্ডনের জন্য যুক্তিতর্ক বিস্তার করিলেও আত্মার স্বরূপ
স্থাপনে সম্পূর্ণ ঐতি-প্রমাণের সাহায্য গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি প্রমাণ করিয়াছেন যে, সমস্ত উপনিষদের উপদেশের তাৎপর্য আত্মেকত্ব। ইহাই উপনিষদবর্ণিত অদ্বৈততত্ত্ব এবং ব্যাসদেব ব্ৰহ্মসূত্ৰতে এই মতই সুশৃঙ্খল দার্শনিক মতবাদরূপে প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। একই আত্মা ভ্রান্তিবশতঃ বহুজীব বলিয়া ও জগৎ বলিয়া প্রতীয়মান হন। প্রকৃত নিরুপাধিক শুদ্ধস্বভাব আত্মা মায়া উপাধিবশতঃ কখনও ঈশ্বর, কখনও জীব, কখনও জড়বস্তু রূপে বিবর্তিত। আত্মার এই বিবর্ত নশ্বর ও মিথ্যা। যাহা কিছু উৎপন্ন ও ক্ষয়ী তৎসৰ্বই অনিত্য ও মিথ্যা। প্রত্যেকটি জাগতিক বস্তুকে বা প্রত্যেক জীবের স্বরূপ পরীক্ষা না করিয়া অদ্বৈতবাদে জগতের মূলতত্ত্ব ও জীবের যথার্থ স্বরূপ অন্বেষণ করা হইয়াছে। সত্য পরমার্থ এবং সেই সত্য বাহিরে না অন্বেষণ করিয়া জীবের অন্তরাত্মাতেই করা উচিত। শ্রুতি বলিয়াছেন, তত্ত্বমসি শ্বেতকেতাে। এই মহাবাক্যে জীবাত্মাকেই নির্বিশেষ পরা সত্য শুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ বলা হইয়াছে। এই উপলব্ধিই পরম দর্শন। কারণ এই অখণ্ড আত্মােপলব্ধি উদ্ভাসিত হইলেই মিথ্যা জগদ্দর্শন নিবৃত্ত হয়। জীবের কর্ম ও কর্মফল মিথ্যা, তাহার ভােগ মিথ্যা ও সংসারবন্ধনও মিথ্যা। এই সমস্তই মায়া বা অবিদ্যার সৃষ্টি। আত্মার স্বরূপেপলব্ধি হইলেই এই অবিদ্যা অবগত হইয়া আত্মাকে মিথ্যা বন্ধন হইতে মুক্তি দেয়, ইহাই মােক্ষ। বাসনা কামনা সম্পূর্ণরূপে তিরােহিত হইয়া মন সম্পূর্ণ শুদ্ধ ও আত্মায় একাগ্ৰধ্যানযুক্ত না হইলে অখণ্ডাকার জ্ঞানের উদ্ভব হয় না। পবিত্র সংযত দেহ-মনে যথার্থ বৈরাগ্যযুক্ত মুমুক্ষু ব্ৰহ্মদর্শী গুরুর সমীপে উপনীত হইয়া ব্ৰহ্মবিদ্যার উপদেশ শ্রবণ করেন। সেই উপদেশ সম্বন্ধে স্বীয় চিত্তের যাবতীয় সন্দেহ তর্কের সাহায্যে অপগত করিয়া বিজ্ঞানানন্দঘন পরম সত্যে চিত্ত নিবিষ্ট করিয়া গভীর ধ্যানের দ্বারা সেই সত্য উপলব্ধি করিয়া কর্তা ভােত্তা প্রভৃতি মায়িক রূপ পরিত্যাগ করেন এবং নির্বিশেষ স্বপ্ৰকাশ চৈতন্যের সহিত অভিন্নস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হন। অবিদ্যাবৃত জীবস্বরূপ বিস্মৃত হইয়া সঞ্চিত কর্মের ফল ভােগ করিতে জন্মগ্রহণ করেন ও নূতন কর্মসঞ্চয় করিয়া মৃত্যুর পরে পুনরায় সেই কর্মফল ভােগার্থে জন্মগ্রহণ করেন। এই ভাবে জন্ম-মৃত্যুর চক্রে তাহাকে আবর্তিত হইতে হয়। জীবের এই কর্তৃত্বাভিমান দূর না হইলে মুক্তি আসে না। অভিমানই জীবের বন্ধনের প্রথম সােপান। আত্মা যখন অবিদ্যাবশতঃ দেহের সহিত নিজের ঐক্য বােধ করে তখনই কর্তা কর্ম ও কৃত্যাত্মক সংসারযাত্রা শুরু হয়। জড়দেহের উপর নির্লিপ্ত চৈতন্যের এই অধ্যাসই সমস্ত
৪৫