পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

________________

অনাত্মবাদ আমরা এই দ্রব্যকেই পাই। দার্শনিক বিশ্লেষণে এই। আত্মা সম্বন্ধে আমরা বিভিন্ন তত্ত্ব অবগত হই। যেমন, আমরা জানিতে পারি যে আত্মা অবিনশ্বর। চার্বাকপন্থী দার্শনিকগণের মতে উপরি-উক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণযােগ্য নহে। তাহাদের মতে দেহই আত্মা। দেহাতিরিক্ত কোনও আত্মা নাই। চার্বাকের মতে (ইন্দ্রিয়- ) প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। অনুমান কিংবা অন্য কোনও প্রমাণ মানা যায় না। ধুম। হইতে বহ্নির অনুমান করিতে হইলে ‘যে স্থলে ধূম সেই স্থলে বহ্নি এই সাধারণ নিয়ম ( বা ব্যাপ্তি ) সম্বন্ধে নিশ্চিত জ্ঞান হওয়া প্রয়ােজন। কিন্তু ধূম অথবা বহ্নির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রতিটি স্থলে পরীক্ষা করা সম্ভব নহে বলিয়া এই সাধারণ নিয়ম সম্বন্ধে আমাদের নিশ্চিত জ্ঞানও সম্ভব নহে। সুতরাং অনুমানকে একটি প্রমাণ বলিয়া মানা যায় না। শব্দাদি অন্যান্য যে সমস্ত প্রমাণের কথা বলা হয় সেইগুলি সবই অনুমানের উপর নির্ভরশীল, অতএব প্রমাণরূপে গ্রাহ্য নহে।। এখন প্রত্যক্ষই যদি একমাত্র প্রমাণ হয় তাহা হইলে আত্মার অস্তিত্বের কোনও প্রমাণ নাই। কারণ, দেহ এবং দেহে উদ্ধৃত চৈতন্য ব্যতীত আত্মা বিষয়ক কোনও প্রত্যক্ষ হয় না। দেহ এবং আত্মার অভেদ আমাদের বাক্যব্যবহার হইতেও সূচিত হয়। আমি স্কুল’, ‘আমি কৃষ্ণবর্ণ প্রভৃতি বাক্য নিশ্চয়ই দেহ ভিন্ন কোনও ‘আমি’ সম্বন্ধে প্রযােজ্য নহে। | চার্বাকের মতে সমস্ত জগৎ-ব্যাপার বায়ু, অগ্নি, অপ ( জল ) এবং ক্ষিতি এই চারিটি ভূত বা মৌলিক উপাদানের সাহায্যেই ব্যাখ্যা করিতে হইবে। কারণ ইহারাই প্রত্যক্ষের বিষয় হইতে পারে ( প্রত্যক্ষগােচর নয় বলিয়া চার্বাকগণ অন্যান্য দর্শনে স্বীকৃত পঞ্চম ভূত আকাশও মানেন নাই।)। সুতরাং তথাকথিত আত্মারও স্বরূপ এই চারিটি ভূতের সাহায্যেই নিরূপণ করিতে হইবে। আত্মা চৈতন্যবিশিষ্ট দেহ মাত্র। এই দেহ বায়ু ইত্যাদি মৌলিক উপাদানে গঠিত এবং চৈতন্য এই দেহেই উদ্ভূত গুণ। যদি বলা হয় যে বায়ু প্রভৃতি মৌলিক উপাদান জড়বস্তুমাত্র এবং তাহাদের কোনওটিতেই চৈতন্য নাই— অতএব তাহাদের দ্বারা গঠিত দেহেও চৈতন্য থাকিতে পারে না, তাহা হইলে চার্বাকগণ বলিবেন যে এই ধারণা ভ্রান্ত। কারণ, তাম্বল চর্বণে যে বক্তবর্ণ উৎপন্ন হয় সেই রক্তবর্ণও তাম্বলের কোনও উপাদানেই বর্তমান নাই। সুতরাং একটি উৎপন্ন দ্রব্যে এমন গুণ থাকিতে পারে যাহা তাহার কোনও উপাদানেই বিদ্যমান নহে।

________________

অনাত্মবাদ বৌদ্ধ দার্শনিকগণও আত্মা বলিয়া কোনও দ্রব্য মানেন নাই। কারণ তাঁহাদের মতে দ্রব্য বলিয়া কিছুই নাই। চার্বাকগণ কিন্তু দেহকে একটি দ্রব্য বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন। | নৈয়ায়িকগণ আত্মাকে কতকগুলি বিশেষ গুণ এবং | কর্মের আশ্রয় হিসাবে মানিয়াছেন। পরন্তু তাহারা আত্মাকে স্থায়ী ও অবিনশ্বর রূপেও বর্ণনা করিয়াছেন। বৌদ্ধ দার্শনিকবৃন্দ এই দুইটি কথাই অস্বীকার করেন। গুণের আশ্রয় রূপে অথবা চির-সৎ পদার্থরূপে- কোনও ভাবেই তাহারা আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেন নাই। | প্রথমে কোনও বিশেষ ব্যক্তির একটি ক্ষণের সত্তা বিশ্লেষণ করা যাইতে পারে। সেই ক্ষণে সেই ব্যক্তির | সত্তা ‘পঞ্চস্কন্ধের সংঘাত (সমষ্টি) মাত্র। পঞ্চস্কন্ধ বলিতে | রূপ (দেহের মৌলিক উপাদানসমূহ ), বিজ্ঞান ( অহং| বােধ ), বেদনা ( সুখ ও দুঃখের অনুভূতি ), সংজ্ঞা ( প্রত্যক্ষ ) এবং সংস্কার (প্রবণতা) বুঝানাে হইতেছে। | কথিত আছে যে গ্রীকরাজা মিলিন্দ ( Menander ) যখন | উপরি-উক্ত মতবাদ গ্রহণ করিতে চাহেন নাই তখন বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগসেন তাঁহাকে বলেন যে রাজ। যে রথে আরােহণ | করিয়া আসিয়াছেন সেই রথ যেমন তাহার অংশগুলির | একটি বিশেষ সংস্থানের নামমাত্র, সেইরূপ রাজা মিলিন্দের | (কোনও এক বিশেষ ক্ষণের ) আত্মাও উপরি-উক্ত পঞ্চ স্কন্ধের সংস্থানের একটি নাম ব্যতীত কিছুই নহে।। | বৌদ্ধ দার্শনিকগণ যে কেবল পঞ্চস্কন্ধের অতিরিক্ত তাহাদের আশ্রয়রূপ আত্মাই অস্বীকার করিয়াছেন তাহ। নহে। তাহারা কোনওরূপেই স্থায়ী আত্মা মানেন নাই। | অর্থাৎ কোনও বিশেষ ক্ষণে আত্ম। যে পঞ্চস্কন্ধের সংঘাত তাহার পরক্ষণে আত্মা ঠিক সেই পঞ্চস্কন্ধেরই সংঘাত হইতে পারে না। কারণ, এই সংঘাতের প্রতিটি উপাদানই ক্ষণিক। উৎপত্তির অব্যবহিত পরক্ষণেই প্রতিটি উপাদান | অপর একটি উপাদান উৎপন্ন করিয়া ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সুতরাং স্বরূপতঃ আত্ম। এইরূপ ক্ষণিক উপাদানসমূহের ধারামাত্র।

এই বৌদ্ধমতের বিরুদ্ধে প্রধান আপত্তি এই হইতে পারে যে ইহাতে ফলতঃ পূর্বজন্ম, পরজন্ম, কর্মফল এবং মুক্তি— সমস্ত কিছুই অস্বীকৃত হইতেছে। কারণ কোনও স্থায়ী আত্মা না থাকিলে জন্মান্তর ইত্যাদি সব কিছুই অর্থহীন হইয়া পড়ে। কিন্তু বৌদ্ধগণ জন্মান্তর প্রভৃতি সমস্ত কিছুই মানিয়াছেন। এই আপত্তির বিরুদ্ধে বৌদ্ধগণ বলিয়াছেন যে কোনও স্থায়ী আত্মা না থাকিলেও পূর্বোক্ত ধারার নিজস্ব ঐক্য এবং সেই অর্থে, স্থায়িত্ব রহিয়াছে।
৫২