পাতা:ভারতবর্ষ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
১৬
ভারতবর্ষ

বিদায় হইব, তখনো সে শান্তচিত্তে আমাদের পৌত্রদের জন্য প্রতীক্ষা করিয়া থাকিবে। সে প্রতীক্ষা ব্যর্থ হইবে না, তাহারা এই সন্ন্যাসীর সম্মুখে করযোড়ে আসিয়া কহিবে—“পিতামহ, আমাদিগকে মন্ত্র দাও।”

 তিনি কহিবেন—“ওঁ ইতি ব্রহ্ম।”

 তিনি কহিবেন-“ভূমৈব সুখং নাল্পে সুখমন্তি।”

 তিনি কহিবেন—“আনন্দং ব্রহ্মণণা বিদ্বান্ ন বিভেতি কদাচন।”



ভারতবর্ষের ইতিহাস।

 আমাদের দেশে রাজা ছিলেন সমাজের একটি অঙ্গ। ব্রাহ্মণ গুরুগণও একভাবে সমাজরক্ষা-ধর্ম্মরক্ষায় প্রবৃত্ত ছিলেন, ক্ষত্রিয় রাজারাও অন্যভাবে সেই কার্যেই ব্রতী ছিলেন। দেশরক্ষা গৌণ, কিন্তু দেশের ধর্মরক্ষাই তাঁহাদের মুখ্য কর্তব্য ছিল। ভারতবর্ষে সাধারণত রাজা সমস্ত দেশকে গ্রাস করেন নাই। তাঁহারা প্রধান ব্যক্তি ছিলেন সন্দেহ নাই, কিন্তু তাহাদের স্থান সীমাবদ্ধ, নির্দিষ্ট ছিল। সেইজন্য রাজার অভাবে ভারতীয় সমাজ অঙ্গহীন হইত, দুর্বল হইত, তবু মরিত না। যেমন এক চক্ষুর অভাবে অন্য চক্ষু দিয়া দৃষ্টি চলে,তেমনি স্বদেশী রাজার অভাবেও সমাজের কাজ চলিয়া গেছে।

 বিদেশী রাজা আর সমস্ত অধিকার করিতে পারে, কিন্তু সামাজিক সিংহাসনের অংশ গ্রহণ করিতে পারে না। সমাজই ভারতবর্ষের মর্ম্মস্থান; সেই সমাজের সহিত বিদেশী রাজার নাড়ীর সম্বন্ধ না থাকাতে যথার্থ ভারতবর্ষের সহিত তাহার সম্বন্ধ অত্যন্ত ক্ষীণ।

 সকল দেশেই বিদেশী রাজা দেশের সম্পূর্ণ অভ্যন্তরে প্রবেশ করিতে পারে না—ভারতবর্ষে আরো বেশি। কারণ, ভারতবর্ষীয় সমাজ দুর্গের ন্যায় দৃঢ় প্রাকাম্বের দ্বারা আপনাকে দুর্গম করিয়া রাখিয়াছে। বিদেশী অনাত্মীয় তাহার মধ্যে অবারিত পথ পায় না। এইজন্য বিদেশী সাম্রাজ্যের ইতিহাস ভারতবর্ষের প্রকৃত ইতিহাস নহে। ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় ইতিবৃত্ত ভারত-ইতিবৃত্তের অতি সামান্য অংশ—তাহা পরিশিষ্টভাগে লিখিত হইবার যোগ্য।