পাতা:মাঝির ছেলে - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
মাঝির ছেলে
১৬

মাইনের টাকা থেকে অর্ধেক হারু মাঝিকে পাঠিয়ে দেবে, কিন্তু নিজে আর ফিরে আসবে না। ভাবে আর নাগার মধ্যে এক আশ্চর্য অনুভূতি জাগে। বিষাদও নয় আনন্দও নয়, কেমন যে লাগছে সে কিছুই বুঝতে পারে না। কেবল মনে হয়, বাড়ি ছাড়ার আগেই যেন তার নতুন জীবন আরম্ভ হয়ে গেছে; আশেপাশের সমস্ত জগৎটা তার বদলে গেছে, অনেক লোকের সঙ্গে মিলেমিশে তার দিন কাটছে যারা সবাই তাকে সরলভাবে ভালোবাসে।

 জিনিসপত্র কি আর আছে নাগার, ছোট একটি পুঁটুলিতেই সব এঁটে গেল। চাটাই-এর বিছানাটি সে নিল না, ন্যাকড়ায় জড়ানো পাশের বালিশটা নেবে মনে করেও শেষ পর্যন্ত ত্যাগ করল। শীতকালে গায়ে দেবার পুরানো মোটা কাঁথাটি কাঠের একটি বাক্সের ওপর ভাঁজ করা ছিল, পুঁটুলিটি শুধু সেই কাঁথায় জড়িয়ে নিল।

 মনটা কেমন খুঁতখুঁত করছিল নাগার। কিছুই সঙ্গে নেবার ইচ্ছা হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, কিছু না নিয়ে নতুন জীবন আরম্ভ করলেই যেন ভাল হয়। ময়লা হাতে ধরলে যেমন পরিষ্কার চকচকে জিনিসে ময়লা লাগে, এখানকার কিছু নিয়ে গেলে তেমনি তার নতুন জীবনে দাগ ধরে যাবে।

 তখনও ভাল করে আলো ফোটে নি। বাড়ি থেকে মেটে রাস্তা ধরে খানিকটা গিয়ে সে ফিরে এল। কাঁথা জড়ানো পুঁটুলিটা দাওয়ায় রেখে আবার বেরিয়ে গেল।

 না, এখান থেকে কিছুই সে সঙ্গে নেবে না।

 পুঁটুলিটা যে বিশেষ ভারী ছিল তা নয়, তবু চলতে চলতে এবার নিজেকে নাগার হালকা মনে হয়। একটু গিয়েই পথটা ডাইনে বেঁকেছে, তার পরেই কৈলাস চক্রবর্তীর বাড়ি, কাল সকালে যিনি যাদববাবুর হাত গুণেছিলেন। বাড়ির সামনে কয়েকটি ফুল গাছ; এত ভোরে স্নান করে উঠে খড়ম পায়ে চক্রবর্তী ফুল তুলছিলেন। তাকে দেখেই হঠাৎ নাগার মনে হল, যাদববাবুর কাছে কাজ নেওয়ার আগে একবার হাতটা দেখালে হয় না?