পেটভরা খাদ্য, আর পরিশ্রমের মর্যাদা তার ভিতরে যে পরিবর্তন এনেছে সেই পরিবর্তনই বাইরের জগৎকেও তার কাছে নতুন করে তুলেছে। আটখামারে সকলের অবহেলা আর নিষ্ঠুরতার মধ্যে যে ক্ষুধাতুর নাগা বাস করত, যাদববাবুর নতুন মাঝিটি যেন সে নাগাই নয়।
নাগা এসেছিল এক কাপড়ে-যাদববাবু তার জামাকাপড় বিছানাপত্র সমস্ত কিছু দরকারী জিনিসের ব্যবস্থাই করে দিয়েছেন। জিনিসগুলি সব নতুন নয় বটে, ছিটের সার্টটা তার গায়ে একটু ছোটই হয় কিন্তু ছেঁড়া বা ফেলনা জিনিস একটি নয়। শোওয়ার জন্য যাদববাবু তাকে একটি তোশক আর বালিশও দিয়েছেন; শোয়ার পর ঘণ্টাখানেক তার বড়ই আরাম বোধ হয়, কিন্তু তারপর তোশকটা গুটিয়ে রেখে সে চাটাই পেতে ঘুমোয়। শক্ত চাটাই-এ ঘুমানো যার অভ্যাস, নরম তোশকে কি ঘুম আসে! তাছাড়া তোশকের বিছানায় যেন গরম লাগে বেশী।
বাড়ির সকলেই নাগাকে একরকম পছন্দ করে, মাধববাবু ছাড়া। প্রথম থেকেই নাগার ওপর ভদ্রলোক একটু বিরূপ। কেন, তা নাগা জানে না। সত্য কথা বলতে কি, বাড়ির সমস্ত চাকরবাকরের ওপরেই তিনি চটা। খুব সম্ভব এদেশের মাইনে-করা মানুষগুলির চালচলন তাঁর পছন্দ হয় না। মনিবদের তারা যেন যথেষ্ট পরিমাণে সম্মান দেখায় না, ভয়ে ঘাড় নীচু করে থাকার বদলে সহজভাবে কথা কয়, ডাক দেওয়ামাত্র হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসার বদলে ধীরে সুস্থে কাছে আসে। অনেকদিনের পুরোনো চাকর গণেশ তো একেবারে ভুলেই থাকে যে সে এবাড়ির চাকর, ঘরোয়া ব্যাপারে পর্যন্ত সে কথা বলতে আসে। এককালে চাকরবাকরের এইরকম সহজ ব্যবহারেই তিনি অভ্যস্ত ছিলেন, অতিরিক্ত বিনয়ে কেউ সর্বদা তটস্থ হয়ে থাকলেই বরং তার সম্বন্ধে সন্দিগ্ধ হয়ে উঠতেন, সে ব্যাটার মতলব ভাল নয়, কিন্তু বহুদিন কলকাতায় থেকে মনটা তাঁর বিগড়ে গেছে। সেখানে মনিব মাইনে দেয়, চাকর কাজ করে, আর কোন সম্পর্কই তাদের মধ্যে থাকে না, এক পক্ষের চটাচটি আর অন্য পক্ষের মনে মনে মনিবের মুণ্ডপাত করতে করতে বাইরে কিছুদিন কেঁচো সেজে থেকে একদিন পালিয়ে যাওয়ার সম্পর্ক ছাড়া।