পাতা:মাঝির ছেলে - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মাঝির ছেলে
৬২

তাকিয়ে নাগা ভাবে, এই কি সমুদ্র? কিন্তু নাগা জানে, এ সমূদ্র নয়, এ শুধু মেঘনা নদীর মোহানা। উপকূলের মায়া ত্যাগ করে পথ সংক্ষেপ করার জন্য ভিমন যখন সন্দীপের গা-ঘেষা লাইনে চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে লঞ্চকে চালায়, জল ছাড়া কোন দিকে যখন আর কিছুই থাকে না, তখন,, নাগার মনে হয়, এই কি সমুদ্র? কিন্তু মনে মনে সে জানে, এও সমুদ্র নয়, এ শুধু সন্দীপ আর চট্টগ্রামের মধ্যে কয়েক মাইল চওড়া সমুদ্রের নকল করা ঢেউ তোলার ছেলেখেলায় মাতোয়ারা বিরাট একটা খাল মাত্র। সমুদ্র চাই নাগার, আসল সমুদ্র, দিনের পর দিন জাহাজ চালিয়েও কোন দিকে যার ডাঙ্গা পাওয়া যাবে না!

 বিকালের দিকে “জলকন্যা’ চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর ফেলল। সন্ধ্যার পর চারজন লোক সঙ্গে নিয়ে সেই ফিরিঙ্গি সায়েবটি এল। ভিমন এখন জানতে পেরেছে তার নাম ডেনিস। ডেনিসের সঙ্গে যে তিনটি লোক এল তাদের চেহারা চাল-চলন কথা আর চোখের দৃষ্টি দেখে নাগা গভীর বিতৃষ্ণা বোধ করতে লাগল। ভিমনার কাছে সে শুনতে পেল, এরা তিনজনেই নাকি পুলিসের এত প্রিয় যে দেখা মাত্র আদর করে গারদে পুরে দেবে।

 কিছুক্ষণ পরেই জলকন্যা পাড়ি জমায় দক্ষিণ দিকে, বন্দরের আলো ঝাপসা হতে হতে একেবারে মিলিয়ে যায়। আর প্রবল উত্তেজনার মধ্যেও মৃদু জ্যোৎস্নার বাড়তি রহস্য ঢাকা সমুদ্রের দিকে চেয়ে নাগা একটু বিষাদ অনুভব করে। এও তার সমুদ্র নয়। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে সমুদ্রে ভেসে বেড়ানোর সাধ বোধ হয় তার কোনদিনই মিটবে না। বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করে সে যদি ভারতমহাসাগরে গিয়ে পড়ে তখনো সে ভুলতে পারবে না যত দূরেই হোক বেলাভূমিতে এই সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে, এ জলরাশি অসীম নয়।

 হুইল ধরে সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে থেকে ভিমনা বলে, “খাসা লঞ্চ, বাইর সাগরে পাড়ি দিয়া বিলাত নিয়া যাইতে পারি।”

 ফিরিঙ্গি সায়েবটি পাশে দাঁড়িয়েছিল। নাগা এখন জানতে পেরেছে। তার নাম ডেনিস। সে হেসে বলল, “বাইর সাগরে কাজ নাই, তুমি ভিতর সাগরেই চল।”