পাতা:মাঝির ছেলে - মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়.pdf/৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
মাঝির ছেলে

 ‘জানাইবো না? তর স্যান খালি খিদা আর খিদা! সারাদিন খাওন ছাড়া তর কাম নাই।’

 একটা পয়সা ছুড়ে দিয়ে হারু তামাক সাজতে বসল। পয়সাটা যে নাগার হাত ফসকে নদীর জলে গিয়ে পড়েছে, তা যেন তার চোখেই পড়ে নি। নাগা চুপ করে থাকে। সকালে তাকে একটা করে পয়সা দেবার কথা হারুর, পয়সা তো হারু দিয়েছে। হাত বাড়িয়ে পয়সাটা অনায়াসে নাগার হাতেই দেওয়া চলত, কিন্তু নাগাকে দেওয়া আর জলে দেওয়া যখন হারুর কাছে সমান, নালিশ করে আর কি হবে! হারু-ই হয় তো পাল্টা নালিশ জানাবে, হাত ফস্‌কে যার পয়সা জলে পড়ে যায়—তার মত বোকা হাবা অপদার্থ মরে না কেন?

 হারু মাঝির কথাটা মিথ্যা নয়, সারাদিন নাগা বড় খাই খাই করে। পেটুক বলে তার রীতিমত বদনাম আছে। আরেকটা বদনাম আছে, চুরি করে খাওয়ার। বাড়ি থেকে, পরের দোকান আর ক্ষেত খামার থেকে চিঁড়া মুড়ি, তিলুড়ি, পাটালি, চালডাল, ফলমূল যা পারে যোগাড় করে সে পেটে চালান দেয়। মাঠে ঘাটে গরু ছাগলের দুধ দুয়ে সঙ্গে সঙ্গে চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেলে। আর নেমন্তন্ন আছে কিনা তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নেমন্তন্ন বাড়িতে গিয়ে পাত পেতে বসে। পেট ভরাবার আরও কত চেষ্টাই যে নাগা করে।

 লোকে বলে নাগার এটা পেটুকপনা; কিন্তু আসল পেটুকপনা তো শুধু মুখরোচক খাবার খাওয়ার লোভ, ভরা পেটে যখন একটা রসগোল্লার স্থান নেই তখন গোটা দশেক পেটে চালান দেবার চেষ্টায় গলদঘর্ম হওয়া? নাগা শুধু পেট ভরাতে চায়, মেটাতে চায় তার খিদের জ্বালা। হয়তো এই পেটুকপনার জন্যই অন্য মাঝিদের ছেলের চেয়ে নাগার শরীরটা অনেক বেশী লম্বা-চওড়া হতে পেরেছে, চেহারায় একটু লাবণ্য আছে। খেতে পায় না বলেই তো মাঝির ছেলেরা বাড়তে পায় না, হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে খাটতে মাংসপেশীগুলি শুধু শক্ত হয়ে দড়ির মত মুচড়ে যায়। এসব ব্যাপার না জেনেও খিদে মেটাবার আগ্রহে নিজেই কিছু কিছু পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা করে নাগা নিজের দেহটাকে পুষ্ট হবার সুয়োগ দিয়েছে।