পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আপনি যতটা বীরেন্দ্রের পরিবারের জন্য করেন, এমন আর কে কাহার জন্য করে? আহা, আপনি না থাকিলে নরেন্দ্রকেই বা কে খাইতে দিত, অন্য লোকেরই বা কে ভরণপোষণ করিত? তাহারা যে দুইবেলা পেট ভরিয়া খাইতে পায়, সে কেবল আপনার অনুগ্রহে। আপনার মত পুণ্যবান লোক কি আর আছে?”

 হর্ষ-গদগদ-স্বরে ঈষৎ-বিস্ফারিত লোচনে নবকুমার উত্তর করিতেন, “না বাপু, আমি পুণ্য জানি না, চিরকালই আমার এই স্বভাব। আজ বীরেন্দ্রের পরিবার বলিয়া কিছু নূতন নহে, ইহাতে দোষ হয়, আমি দোষী, পুণ্য হয়, তাহাই” ইত্যাদি ইত্যাদি।

 আমরা পূর্বেই বলিয়াছি, নবকুমার নিতান্ত মন্দ লোক ছিলেন না। চাহিয়া দেখ, সকলেই নবকুমারকে বিচক্ষণ বুদ্ধিমান লোক বলিয়া সমাদর করিতেছে। শুন, সকলেই তাঁহাকে দয়াশীল, ব্রাহ্মণভক্ত লোক বলিয়া খ্যাতি করিতেছে। অদ্যাপি নবকুমারের ন্যায় লোক লইয়া আমাদের সমাজ গর্বিত রহিয়াছে, তাঁহাদের সর্বস্থানে সমাদর, সর্বস্থানে প্রশংসা, সর্বস্থানে প্রভুত্ব। মানী জ্ঞানী বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন নবকুমার মরিলে সমাজ শিরোমণি হারাইবে, সমাজে হুলস্থূল পড়িয়া যাইবে। যিনি সর্বস্থানে আদৃত, সকলের মান্য, তোমার আমার কি অধিকার আছে তাহার নিন্দা করি?

তিন

 আমরা পূর্বেই বলিয়াছি, শৈবলিনী সন্ধ্যার সময় ঘাট হইতে ফিরিয়া আসিলেন। ধর্মপরায়ণ শান্তচিন্তা বিধবা সন্ধ্যায় পূজা সমাপ্ত করিয়া বালক-বালিকাগুলিকে লইয়া গল্প করিতে বসিলেন। শৈবলিনী মাসে কি দুই মাসে বীরনগরে আসিতেন। শৈবলিনী বড় গল্প করিতে পারিতেন। শৈবলিনীর সন্তানাদি নাই, সকল শিশুকেই আপনার বলিয়া মনে করিতেন। এই সমস্ত কারণে শৈবলিনী বালক-বালিকাদিগের বড় প্রিয়পাত্রী। শৈব আসিয়াছেন, গল্প করিতে বসিয়াছেন, শুনিয়া এই প্রকাণ্ড অট্টালিকার সমস্ত বালকবালিকা একত্র হইল, কেহই শৈবলিনীর অনাদরের পাত্র ছিল না। কাহাকেও ক্রোড়ে, কাহাকেও পার্শ্বে, কাহাকেও সম্মুখে বসাইয়া শৈবলিনী মহাভারতের অমৃতমাখা গল্প করিতে লাগিলেন। আমরা এই অবসরে শৈবলিনীর বিষয়ে দুই-একটি কথা বলিব।

 শৈবলিনীয় পিতা সামান্য সঙ্গতিপন্ন ও অতিশয় ভদ্রলোক ছিলেন। শ্রীশচন্দ্র ও শৈবলিনী পিতার গুণগ্রাম ও মাতার ধীরস্বভাব ও নম্রতা পাইয়াছিলেন, অতি অল্প বয়সে শৈবলিনী বিধবা হইয়াছিলেন, স্বামীর কথা মনে ছিল না, সংসারে সুখ-দুঃখ প্রায় জানিতেন না, এ জন্মে চির-কুমারী বা চির-বিধবা হইয়া কেবল মাতার সেবা ও ছোট ভাইটির যত্ন ভিন্ন আর কোন ধর্ম জানিতেন না।

 শৈবলিনীর পিতার মৃত্যুর পর তাঁহাদের অবস্থা ক্রমশ মন্দ হইতে লাগিল, এমন কি,

১০