পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/১০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

স্তম্ভছায়া ভূমিতে পতিত হইয়াছে। পাশে বিশাল যমুনা নদী চন্দ্রকরে নিস্তব্ধে বহিয়া যাইতেছে ও রহিয়া রহিয়া শীতল যমুনার বায়ু মন্দিরের ভিতর দিয়া বহিয়া যাইতেছে। সেই সুস্নিগ্ধ রজনীতে পবিত্র মন্দিরের একটি স্তম্ভছায়াতে নিস্তব্ধ নরেন্দ্র ও হেম দাঁড়াইয়া রহিয়াছে।

 হেম স্থিরভাবে বলিল, “নরেন্দ্র! অনেকদিন পর আমাদের দেখা হইয়াছে, আবার বোধ হয়, অনেকদিন দেখা হইবে না, আইস, আমাদেব মনের যে কথা, তাহাই কহি। নরেন্দ্র! বাল্যকালে আমরা দুইজনে গঙ্গাতীরে খেলা করিতাম, কত স্বপ্ন দেখিতাম। এক্ষণে তুমি সৈনিকের কার্যে ব্রতী হইয়াছ, আমি পরের স্ত্রী। নরেন্দ্র, বাল্যকালের স্বপ্ন একেবারে বিস্মৃত হও।”

 হেমলতা ক্ষণেক নিস্তব্ধ হইয়া রহিল, আবাব বলিল, “বিধাতা যদি অন্যরূপ ঘটাইতেন, তবে আমাদের জীবন অন্যরূপ হইত, বাল্যকালের স্বপ্ন সফল হইত। কিন্তু নরেন্দ্র, আমরা যেন ভ্রমেও বিধাতার নিন্দা না করি। যিনি তোমাকে পরাক্রম দিয়াছেন, যশ দিয়াছেন তাঁহার নাম লও, অবশ্য তোমাকে সুখী করিবেন। যিনি আমাকে এই সংসারে স্থান দিয়াছেন, দেবতুল্য স্বামী দিয়াছেন, শৈবলিনীর ন্যায় ননদিনী দিয়াছেন, ধন-ঐশ্বর্য দিয়াছেন তিনি দয়ার সাগর, তাহাকে আমি প্রণাম করি।”

 হেমলতা গলায় বস্ত্র দিয়া করজোড়ে বিশ্বের আদি-পুরুষকে লক্ষ্য করিয়া প্রণাম করিল। তার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল, পবিত্র, শাস্তি-রসে পরিপুর্ণ।

 নরেন্দ্র বিস্মিত হইয়া হেমলতার মুখের দিকে চাহিল, তাহার বাক্যস্ফূর্তি হইল না। হেমলতা আবার বলিতে লাগিল, “নরেন্দ্র, আমি শুনিয়াছি, তুমি অনেক যুদ্ধ করিয়াছ, অনেক দেশ ভ্রমণ করিয়াছ, সকল দেশেই সুখ্যাতি লাভ করিয়াছ। তুমি পুণ্যাত্মা, জগদীশ্বর তোমাকে সুখে রাখুন। কিন্তু যদি যুদ্ধে শ্রান্ত হইয়া বিশ্রাম আকাঙ্ক্ষা কর, যদি বিপদ বা দারিদ্রে পতিত হও, আবার বীরনগরে যাইও, তুমি যাইলে সকলেই আহ্লাদিত হইবে। আমার স্বামীর হৃদয় আমি জানি, তিনি তোমাকে কনিষ্ঠের ন্যায় ভালবাসেন, সর্বদাই সস্নেহে তোমার কথা কহেন, তুমি যাইলেই তিনি অতিশয় আহ্লাদিত হইবেন।”

 নরেন্দ্র নিস্তব্ধ হইয়াছিল, হেমের কথাগুলি তাঁহার কর্ণে অপূর্ব সঙ্গীতধ্বনির ন্যায় বোধ হইতেছিল। তাঁহার হৃদয় পরিপূর্ণ, তাঁহার নয়ন দুটিও পরিপূর্ণ।

 হেম আবার বলিতে লাগিল, “আর তুমি যাইলে শৈবলিনীও কত আহ্লাদিত হইবেন। আর হেমলতা যতদিন জীবিত থাকিবে, কনিষ্ঠা ভগিনীর ন্যায় তোমার সেবাশুশ্রূষা করিবে। ভাই নরেন্দ্র। আমি তোমাকে যখন দেখিব, তখনই আহ্লাদিত হইব।”

১০০