পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/১০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 এই স্নেহবাক্য শুনিয়া নরেন্দ্রের চক্ষুতে আবার জল আসিল, আবার দুইজনে অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিল।

 শেষে হেম ঈষৎ গম্ভীরস্বরে বলিল, “নরেন্দ্র, আর একটি কথা আছে, কিছু মনে করিও না, আমার দোষ গ্রহণ করিও না। নরেন্দ্র, আমাদের বিদায়কালে প্রণয়চিহ্নস্বরূপ আমাকে একটি দ্রব্য দিয়াছিলে, সেটি এখন পরিধান করিতে আমি অধিকারিণী নাহি। নরেন্দ্র, সেটি ফিরাইয়া লও।”

 হেমলতা আপন হস্তের বস্ত্র তুলিয়া লইল, নরেন্দ্র দেখিল, যে মাধবীকঙ্কণ নরেন্দ্র দিয়াছিল, তাহা এখনও রহিয়াছে। লতা শুষ্ক হইয়া খণ্ড খণ্ড হইয়া গিয়াছে, হেমলতা সেই অসংখ্য খণ্ডকে একে একে সুতার দ্বারা গ্রথিত করিয়া রাখিয়াছিল, অদ্য তাহাই পরিধান করিয়া আসিয়াছে।

 উভয়ের পূর্বকথা মনে আসিতে লাগিল, উভয়ের হৃদয় বিষাদচ্ছায়ায় আচ্ছন্ন হইল, উভয়েই অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। নবেন্দ্র হেমলতার সেই সুন্দর বাহু ও সেই মাধবীকঙ্কণ দেখিতে লাগিলেন, দেখিতে দেখিতে তাঁহার নয়ন জলে পরিপূর্ণ হইল, আর দেখিতে পারিলেন না। অবশেষে দরবিগলিত ধারায় অশ্রুবারি পড়িয়া হেমলতার হস্ত ও বাহু সিক্ত করিল। অবশেষে নরেন্দ্র একটি নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া বলিলেন, “হেম তবে কি জন্মের মত আমাকে বিস্মৃত হইবে?”

 হেম বলিল, “জীবিত থাকিতে তোমায় বিস্মৃত হইব না; চিরকাল সহোদরের ন্যায় তোমার কথা ভাবিব। কিন্তু এই কঙ্কণ অন্য প্রণয়ের চিহ্নস্বরূপ আমাকে দিয়াছিলে, নরেন্দ্র অমি সে প্রণয়ের অধিকারিণী নহি। নরেন্দ্র মনে ক্লেশবোধ করিও না, আমি এই কয় বৎসর এ কঙ্গণটি পূজা করিয়াছি, হৃদয়ে রাখিয়াছি, উহা ত্যাগ করতে আমার যে কষ্ট হইতেছে, তাহা তুমি জান না। কিন্তু এটি উন্মোচন কর, ইহাতে আমার অধিকার নাই। নরেন্দ্র আমি অবিশ্বাসিনী পত্নী নহি।”

 নরেন্দ্র আর কোন কথা কহিলেন না। নিঃশব্দে হেমলতার হস্ত হইতে কঙ্কণ খুলিয়া লইলেন।

 তখন হেমলতা বলিল, “নরেন্দ্র! আমি চলিলাম, তুমি ধর্মপরায়ণ, বাল্যকাল হইতে ধর্মে তোমার আস্থা আছে, সে ধর্ম কখনও বিস্মৃত হইত না, জগদীশ্বর তোমাকে সুখে রাখিবেন। তিনি যাহাকে যাহা করিয়াছেন, যেন আমরা সেইরূপ থাকিতেই চেষ্টা করি। পুষ্পটি দুই একদিন সুগন্ধ বিস্তার করিয়া শুষ্ক হইয়া যায়, পক্ষীটি আলোকে প্রফুল্ল হইয়া গান করে, তাহাদের সেই কার্য। নরেন্দ্র, তুমি বীরপুরুষ, শত্রুকে জয় কর, দেশের মঙ্গল কর, পদাশ্রিত ক্ষীণের প্রতি দয়া করিও। আর ভগবান

১০১