পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/১০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

যেরূপ খেলা করিত, বাষ্পোৎফুল্ললোচনে হেমলতা দেখিলেন, তাহার পুত্রকন্যাগণ সেইস্থানে সেইরূপ খেলা করিতেছে, দৌড়াদৌড়ি করিতেছে, আনন্দধ্বনিতে চারিদিকের কুঞ্জবন প্রতিধ্বনিত হইতেছে। সংসারের এই গতি, এক দল যাইতেছে, অন্য দল আসিতেছে। শিশুদিগের ললাট পরিষ্কার, নয়ন উজ্জল, মুখমণ্ডল চিন্তাশূন্য এখনও মানবজীবনের চিন্তা সে স্বর্গীয় অবয়বে অঙ্কিত হয় নাই।

 হেমলতার বিবাহের প্রায় দশ বৎসর পর হেমলতা পুত্রকন্যা গুলিকে লইয়া একটি সন্ন্যাসীর আবাস দেখিতে গেলেন। বীরনগর হইতে কয়েক ক্রোশ দূরে একটি প্রসিদ্ধ শিমুলবৃক্ষ ছিল। শিমুল-বৃক্ষের গুঁড়ি হইতে প্রায়ই তিনদিকে তিনটি দেওয়ালের মত পাট বাহির হয়, এই বৃক্ষের সেই পাটগুলি এত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়াছিল, বোধ হইত, যেন একটি উন্নত ঘর হইয়াছে। সেই অপরূপ ঘরে একজন সন্ন্যাসী কয়েক বৎসর অবধি বাস করিতেছিলেন। পল্লী-গ্রামস্থ গৃহিণী ও বালিকাগণ সস্নেহে সেই সন্ন্যাসীকে প্রত্যহ দুগ্ধ ও ফলমূল আনিয়া দিত, তাহাতেই তিনি জীবনধারণ করিতেন। সমস্ত দিন তিনি প্রায় ধ্যানে রত থাকিতেন, সায়ংকালে সেই গ্রামের ভিতর গৃহে গৃহে যাইতেন, শোকবিদগ্ধকে সান্ত্বনা করা, পীড়িতকে শুশ্রূষা করা, দুর্বলকে সাহায্য করা, মানবের কষ্ট নিবারণ করা তাহার জীবনের কার্য। গভীর রজনী পর্যন্ত এই কার্য করিয়া আবার তিনি সেই তরুগৃহে ফিরিয়া আসিতেন, তথায় ঘাসের উপর কি শীত, কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা সকল কালেই তিনি সমভাবে নিদ্রা যাইতেন। সেই তরুগৃহ ও সেই সন্ন্যাসীকে দেখিবার জন্য অনেক দেশ হইতে অনেক লোক আসিত।

 হেমলতা বৃক্ষের কিঞ্চিদ্দুরে নৌকা হইতে অবতরণ করিলেন, ধীরে ধীরে পদব্রজে তরুর নিকট যাইয়া সন্ন্যাসীকে উপলক্ষ করিয়া একটি প্রণাম কহিলেন, পরে অপিন শিশুটিকে ক্রোড়ে লইয়া দণ্ডায়মান হইয়া সেই সন্ন্যাসীর দিকে দেখিতে লাগিলেন। সেদিক হইতে অর নয়ন ফিরাইতে পারিলেন না, নিস্পন্দভাবে দেখিতে লাগিলেন। সন্ন্যাসীও হেমলতার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিতেছিলেন, তিনি প্রীত-নয়নে হেমলতাকে প্রণাম করিতে দেখিলেন, সতৃষ্ণনয়নে হেমলতার কমনীয় কন্যাপুত্রের দিকে চাহিয়া রহিলেন। বোধ হইল, যেন দেখিতে দেখিতে সন্ন্যাসীর হৃদয় একবার আলোড়িত বোধ হইল; চক্ষু একবিন্দু জলে অবৃিত হইল, অবশেষে সন্ন্যাসী ধীরে ধীরে হেমের নিকটে আসিয়া শিশুদিগের মাথায় হাত দিয়া আশীর্বাদ করিলেন, পরে হেমলতার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে অবলোকন করিয়া বলিলেন, “আমি আশীর্বাদ করিতেছি, তোমার দেবতুল্য স্বামীতে যেন তোমার অচলা ভক্তি থাকে, জনমে-মরণে যেন চির পতিব্রতা হইয়া থাক।”

 সন্ন্যাসী ধীরে ধীরে চলিয়া গেলেন। তাহার পর আর কেহ সে তরুতলে সন্ন্যাসীকে দেখিতে পাইল না, সন্ন্যাসী যে সে গ্রাম হইতে কোথায় চলিয়া গেলেন, কেহ আর জানিতে পারিল না।

১০৪