পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

হিন্দু বণিক ব্যবসায়ী লোক শান্তভাবে নগরের একপার্শ্বে বাস করিত ও নিজ নিজ ব্যবসায়ে রত থাকিত।

 এ সমস্ত দেখিবার জন্য নরেন্দ্রনাথ রাজমহলে যান নাই, এ সমস্ত দেখিয়া তিনি শান্ত হইলেন না; কিরূপে সুবাদারের নিকট আবেদন জানাইবেন, তাহাই চিন্তা করিতে লাগিলেন। অনেক ধনাঢ্য হিন্দুবণিক নরেন্দ্রের পিতাকে চিনিতেন, কিন্তু নরেন্দ্র এক্ষণে দরিদ্র, দরিদ্রের জন্য কে চেষ্টা করে? নরেন্দ্র যাঁহার নিকট যাইলেন, তিনিই বলিলেন “হাঁ বাপু, তোমার পিতা মহাশয় লোক ছিলেন, তাঁহার পুত্রকে দেখিয়া বড় সন্তুষ্ট হইলাম, কয়েকদিন এইস্থানে অবস্থিতি কর, পরে দেখা যাইবে,” ইত্যাদি। নরেন্দ্র বিফল প্রযত্ন হইয়া রহিলেন।

 অনেকদিন পর ঘটনাক্রমে এর্‌ফান খাঁ নামক কোন মোগল জায়গীরদারের সহিত নরেন্দ্রের পরিচয় হইল। এর্‌ফান খাঁ বীরেন্দ্রের পরম বন্ধু এবং যথার্থ মহাশয় লোক ছিলেন, তিনি সাদরে নরেন্দ্রকে আহ্বান করিয়া সত্বর তাঁহার জন্য সুবাদারের নিকট যাইতে প্রতিশ্রুত হইলেন। তথাপি দরিদ্রের আবেদন বিচারাসন পর্যন্ত যায় না, অনেক যত্নে, অনেকদিন পরে এর্‌ফান খা বহু অর্থে সুবাদার ও তাঁহার মন্ত্রিবর্গের মন পরিতুষ্ট করিয়া একদিন নরেন্দ্রনাথের আবেদন সুজার সম্মুখে উপস্থিত করিলেন।

 সুন্দর রৌপ্য ও স্বর্ণখচিত সিংহাসনে সুবাদার বসিয়াছেন, রাজবেশ সে সুন্দর অবয়বে বড় সুন্দর শোভা পাইতেছে। চারিদিকে অমাত্য ও বড় বড় আফগান ও মোগল যোদ্ধাগণ শির নত করিয়া দণ্ডায়মান রহিয়াছেন ও বহুবিধ লোকে বিস্তীর্ণ বিচার প্রাসাদ পরিপূর্ণ রহিয়াছে। প্রস্তরবিনির্মিত সারি সারি স্তম্ভের উপর চারুখচিত ছাদ শোভা পাইতেছে, সিংহাসনের দুইদিকে পরিচারক চামর দুলাইতেছে। প্রাসাদের বাহিরে যতদূর দেখা যায়, লোকে সমাকীর্ণ সুবাদার সর্বদা দেখা দেন না, সেইজন্য অন্য সকলেই দেখিতে আসিয়াছে।

 সুবাদারের সম্মুখে বৃদ্ধ এর্‌ফান খাঁ উঠিয়া আবেদন করিলেন, জাঁহাপনা, এ দাস প্রায় বিংশতি বৎসর সম্রাটের কর্ম করিয়াছে, সুবাদারের কার্যে আমার কেশ শুক্ল হইয়াছে, ললাট খড়ে্গ ক্ষত হইয়াছে। গোলামের কিঞ্চিৎ আবেদন আছে।”

 সুবাদার বলিলেন, “এর্‌ফান, তুমি আমাদের প্রধান অনুচর ও অতিশয় প্রিয়পাত্র, তোমার এমন কি যাঞা আছে, যাহা আমাদের অদেয়?”

 এর্‌ফান ভূমি পর্যন্ত শির নোয়াইয়া পুনরায় বলিলেন, জাঁহাপনা! বঙ্গদেশবাসিগণ অতি দুর্বল; তাহাদের মধ্যে সময়ে সময়ে যে পরাক্রান্ত জমিদারগণ আমাদিগের যুদ্ধে সাহায্য করে, তাহার সুবাদারের প্রীতিভাজন সন্দেহ নাই। জমিদার বীরেন্দ্র সিংহ একজন সেইরূপ লোক ছিলেন।”

২২