পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 সুবাদার বলিলেন, “হাঁ, আমি সেই হিন্দুর নাম শুনিয়াছি, পাঠানদিগের সহিত আমাদের যুদ্ধে সে সাহায্য করিয়াছিল।”

 এর্‌ফান পুনরায় তসলীম করিয়া বলিল, জাঁহাপনা! যাহা কহিলেন, যথার্থ। এই দাস যখন উড়িষ্যার যুদ্ধে গিয়াছিল, স্বচক্ষে বীরেন্দ্রের যুদ্ধ-কৌশল ও রাজভক্তি দেখিয়াছিল। এই রাজসভায় অনেক পরাক্রান্ত পাঠান ও মোগল যোদ্ধা আছেন; কিন্তু বীরেন্দ্র অপেক্ষা অধিক সাহসী পুরুষ এ গোলাম এ পর্যন্ত দেখে নাই।”

 সভাস্থদিগের কোষে অসি ঝন্ ঝনার শব্দ হইল, মুসলমানদিগের মুখ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল; কিন্তু সুজা সহাস্যবদনে বলিলেন “এর ফান, তুমি কাফেরের অত্যন্ত প্রশংসা করিয়াছ, তা অযথার্থ নহে, সে হিন্দু যথার্থ সাহসী ছিল শুনয়াছি। এক্ষণে তাহার জন্য কি বলিবার আছে বল, তোমার উপরোধে আমি তাহাকে যে-কোন পুরস্কার দিতে প্রস্তুত আছি।”

 এর্‌ফান গম্ভীর স্বরে বলিলেন, “যিনি সুবাদারের উপর সুবাদার বাদশাহের উপর বাদশাহ, তিনিই কেবল এক্ষণে বীরেন্দ্রকে পুরস্কার বা শাস্তি দিতে পারেন। আমি তাঁহার অনাথ বালকের জন্য আবেদন করিতেছি। বালক এক্ষণে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিতেছে, কানঙ্গু মহাশয়ের যোগে এক শঠ তাহার পৈতৃক জমিদারি কাড়িয়া লইয়াছে।”

 ভ্রূ-কুঞ্চিত করিয়া সুবাদার কানঙ্গুকে সবিশেষ জিজ্ঞাসা করিলেন। সে সময় সমস্ত খাজনা ও জমিদারীর বিষয় কানঙ্গু মহাশয়ের হস্তে থাকিত; এমন কি, বঙ্গদেশের সুবাদার যে সমস্ত কাগজপত্র দিল্লীতে পাঠাইতেন, তাহাও কানঙ্গুর সহি না হইলে গ্রাহ্য হইত না। কানঙ্গু মহাশয় নবকুমারের অর্থভোগী বিনীতভাবে তিনি বলিলেন “সুবাদার মহাশয়ের আদেশ আমাদের শিরোধার্য; বীরেন্দ্রের মৃত্যুর পর কয়েক বৎসর খাজনা আদায় না হওয়ায় জাঁহাপনা সেই জমিদারি নবকুমারকে দিতে আদেশ দিয়াছিলেন।”

 সুজাকে কোন বিষয় বুঝাইয়া দেওয়া কঠিন ছিল না, কানঙ্গু মহাশয় যাহা বুঝাইলেন, সুবাদার তাহাই বুঝিলেন, এর্‌ফানের আবেদন ফাঁসিয়া গেল। এর্‌ফান রোষে নতশির হইয়া রহিলেন, তাঁহার দক্ষিণ পাশে দণ্ডায়মান হইয়া নরেন্দ্র কানঙ্গু মহাশয়ের দিকে তীব্রদৃষ্টি করিতেছিলেন।

 সুবাদার শেষে বলিলেন, “এর্‌ফান খাঁ। সূর্য যে রশ্মি জগতে দান করেন, তাহা ফিরাইয়া লন না, জমিদারী স্বয়ং দান করিয়া ফিরাইয়া লওয়া রাজধর্ম নহে; বীরেন্দ্রের বালক তেজস্বী দেখিতেছি, বীরেন্দ্রের মত যুদ্ধব্যবসায় শিক্ষা করুক অবশ্যই উৎকৃষ্ট পুরস্কার ও অন্য জমিদারী এনাম পাইবে।”

 সভাস্থ সকলে “কেরামৎ” “কেরামৎ” বলিয়া সুবাদারের কথার প্রশংসা করিল;

২৩