পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নয়ে সেই অপ্সরা বা নারীরেখার দিকে চাহিয়া দেখিলেন, তাহার নিয়ে রেখাকারে দণ্ডায়মান রহিয়াছে সকলেই বক্ষের উপর দুই হস্ত স্থাপন করিয়া ভূমির দিকে চাহিয়া রহিয়াছে, দেখিলে জীবনশুন্য পুত্তলির ন্যায় বোধ হয়। তাহাদের কেশপাশ হইতে মণি-মুক্তা দীপালোক প্রতিহত করিতেছে, উজ্জল বহুমূল্য বসন সেই আলোকে অধিকতর উজ্জ্বল দেখাইতেছে। তাহারা সকলেই যেন রাজ্ঞীর আদেশসাপেক্ষ হইয়া নিঃশব্দে দণ্ডায়মান রহিয়াছে।

 সেই রাজ্ঞীর দিকে যখন চাহিলেন, নরেন্দ্র তখন শতগুণ বিস্মিত হইলেন। যৌবন অতীত হইয়াছে, কিন্তু যৌবনের উজ্জ্বল সৌন্দর্য ও উন্মত্ততা এখনও বিলীন হয় নাই, বোধ হয় যেন প্রথম যৌবনের বেগ ও লালসা বয়সে আরও বৃদ্ধি পাইয়াছে। রাজ্ঞীর শরীর উন্নত, ললাট প্রশস্ত, ওষ্ঠ সমস্ত বদনমণ্ডল রক্তবর্ণ, কৃষ্ণ কেশপাশ হইতে একটিমাত্র বহুমূল্য হীরকখণ্ড আলোকে ধক্ ধক্ করিতেছে। নয়নদ্বয় তদপেক্ষা অধিক জ্যোতি সহিত উজ্জ্বল মখমলের অবগুঠনে সে উজ্জ্বলতা গোপন করিতে অক্ষম। দেখিলেই বোধ হয়, নারী হউন বা অপ্সরা হউন, ইনি কোন অসাধারণ মহিলা জগৎ বা স্বর্গপুরী শাসন করিবার জন্যই ধরাতে অবতীর্ণ হইয়াছেন।

 কিন্তু নরেন্দ্রের এসমস্ত দেখিবার অবসর ছিল না। সহসা যেন স্বর্গীয় বাদ্যযন্ত্র হইতে কোন স্বর্গীয় তান উত্থিত হইতে লাগিল। তাহার সহিত সেই শত অপ্সরা কণ্ঠধ্বনি মিশ্রিত হইতে লাগিল। সেরূপ-অপরূপ গীত নরেন্দ্র কখনও শুনেন নাই, তাহার সমস্ত শরীর কণ্টকিত হইল, তিনি নিশ্চেষ্ট হইয়া সেই গীত শ্রবণ করিতে লাগিলেন। সেই গীত ক্রমে উচ্চতর হইয়া সেই উন্নত প্রাসাদ অতিক্রম করিয়া, নৈশ গগণে বিস্তার পাইতে, লাগিল, বোধ হয় যেন, নৈশ গগণবিহারী অদৃষ্ট জীবগণ সেই গীতের সহিত যোগ দিয়া শতগুণ বর্ধিত করিতে লাগিল। ক্রমে আবার মন্দীভূত হইয়া সে গীত ধীরে ধীরে লীন হইয়া গেল, আবার প্রাসাদ নিস্তব্ধ—শব্দশূন্য। এইরূপ একবার, দুইবার, তিনবার গীতধ্বনি শ্রুত হইল। সেই গীতধ্বনি ক্রমে লীন হইয়া গেল।

 তখন রাজ্ঞী সজোরে পদাঘাত করায় সেই প্রাসাদের একদিকের একটি রক্তবর্ণ যবনিকা পতিত হইল। নরেন্দ্র সভয়ে চাহিয়া দেখিলেন, তাহার অপর পাশে চারিজন কুঠারধারী কৃষ্ণবর্ণ খোজা রক্তবর্ণ পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া দণ্ডায়মান রহিয়াছে। রাজ্ঞী পূনরার পদাঘাত করায় তাহাদের মধ্যে প্রধান একজন রাজ্ঞীর সিংহাসনপার্শ্বে যাইয়া দণ্ডায়মান হইল। নরেন্দ্র দেখিলেন, সে মসরুর। নরেন্দ্রের ধমনীতে শোণিত শুষ্ক হইয়া গেল।

 মসরুর রাজ্ঞীর সহিত অনেকক্ষণ অতি মৃদুস্বরে কথা কহিতে লাগিল কি বলিতেছিল

৩৩

মাধবীকঙ্কণ-৩