পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

নরেন্দ্র তাহা শুনিতে পাইলেন না; কি কথা কহিতে কহিতে মধ্যে মধ্যে সে নরেন্দ্রের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিতে লাগিল, মধ্যে মধ্যে দম্ভে দম্ভে ঘর্ষণ করিয়া নয়ন আরক্ত করিয়া, যেন কি উত্তেজনা প্রকাশ করিতে লাগিল। মসরুর কি বলিতেছিল, নরেন্দ্র তাহা জানিতে পরিলেন না, কিন্তু তাহার আকৃতি ও অঙ্গভঙ্গি দেখিয়া নরেন্দ্রের হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার হইতে লাগিল। নরেন্দ্রকে এই অপরিচিত দেশে জল্লাদহস্তে প্রাণ দিতে হইবে, তাঁহার প্রতীতি হইল।

 রাজ্ঞী পুনরায় পদাঘাত করিলেন। তৎক্ষণাৎ প্রাসাদের অন্য পারে একটি হরিদ্বর্ণ যবনিকা পতিত হইল। তাহার অপর পাশে চারিজন পরিচারিকা হরিদ্বর্ণ পরিয়ে দণ্ডায়মানা রহিয়াছে। দ্বিতীয়বার পদাঘাত করায় সেই পরিচারিকাগণ একজন বন্দীকে রাজ্ঞীর নিকট ধরিয়া আনিল। নরেন্দ্র সবিস্ময়ে দেখিলেন সে বন্দী জেলেখা। জেলেখা কি বলিল, নরেন্দ্র তাহা শুনিতে পাইলেন না, কিন্তু তাহার আকার ও অঙ্গভঙ্গি দেখিয়া বোধ হইল, সে রাজ্ঞীর অনুগ্রহ প্রার্থনা করিতেছে, অশ্রুত্যাগ করিয়া রাজ্ঞীর পদে লুষ্ঠিত হইতেছে।

 রাজ্ঞী বার বার নরেন্দ্রের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। নরেন্দ্র স্বভাবতঃ গৌরবর্ণ তাঁহার নয়ন জ্যোতিঃ-পরিপূর্ণ. ললাট উন্নত, বদনমণ্ডল উগ্র ও তেজোব্যঞ্জক। সাহসী, অল্পবয়স্ক সুন্দর যুবার উন্নত ললাট ও প্রশস্ত মুখমণ্ডলের দিকে রাজ্ঞী বার বার নয়নক্ষেপণ করিতে লাগিলেন।

 নরেন্দ্রের দিকে অনেকক্ষণ চাহিতে চাহিতে রাজ্ঞী নরেন্দ্রের অঙ্গুলীতে একটি অঙ্গুরীয় দেখিতে পাইলেন, হতভাগিনী জেলেখা নরেন্দ্রের পীড়ার সময়ে একদিন লীলাক্রমে সে অঙ্গুরীয়টি পরাইয়া দিয়াছিল, সেই অবধি তাহা নরেন্দ্রের হাতে ছিল। অঙ্গুরীয় রাজ্ঞীর পরিচারিকাগণ চিনিল, রাজ্ঞী স্বয়ং চিনিলেন। তখন ক্রোধে রাজ্ঞীর সুন্দর ললাট রক্তবর্ণ হইল, নয়ন হইতে অগ্নি বহির্গত হইল।

 বিচার শেষ হইল। নির্দয়হৃদয়া রাজ্ঞী আদেশ দিলেন, জেলেখা অপরাধিনী, পাপীয়সীকে শূলে দাও। কাফেরকে লইয়া যাও, হস্তিপদে দলিত করিয়া কাফেরকে হনন কর?” একেবারে দীপাবলী নির্বাণ হইল। নিঃশব্দে অন্ধকারে খোজাগণ রজ্জু দ্বারা নরেন্দ্রকে বন্ধন করিতে লাগিল।

 অন্ধকারে নরেন্দ্রের মুখের নিকট একটি পাত্র ধারণ করিল। নরেন্দ্র বিস্ময় ও উদ্বেগে তৃষ্ণার্ত হইয়াছিলেন, সেই পাত্র হইতে পানীয় পান করিলেন, অচিরাৎ অচেতন হইয়া পড়িলেন। তাহার পর কি হইল, তিনি জানিলেন না, কেবল বোধ হইল যেন সেই অন্ধকারে কে আসিয়া তাঁহার হইতে সেই অঙ্গুরীয় উন্মোচন করিল, আর কে যেন

৩৪