পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

 গজপতি। ওটি জুম্মা মসজিদ। শুনিয়াছি একটি পর্বতের উপরিভাগে সমতল করিয়া তাহার উপর মসজিদ নির্মিত হইয়াছে। উহার আরক্তবর্ণে নয়ন ঝলসাইয়া যাইতেছে, তাহার উপর শ্বেতপ্রস্তরের তিনটি গম্বুজ উঠিয়াছে। বাদশাহ যখন দিল্লীতে থাকেন স্বয়ং ঐ মসজিদে প্রতি শুক্রবার যান, সে সমারোহ তুমি একদিন দেখিলে কখনও ভুলিতে পারিবে না। দুর্গ হইতে মজিদ পর্যন্ত চারি-পাঁচ শত সিপাহী সারি দিয়া দাঁড়ায়। তাহাদের বন্দুকের ওপর হইতে সুন্দর রক্তবর্ণ পতাকা উড়িতে থাকে। পাঁছ ছয় জন অশ্বারোহী পথ পরিষ্কার করিতে করিতে আগে যায়, পরে বাদশাহ হস্তীর উপর জাজ্জল্যখান সিংহাসনে আরোহণ করিয়া যান, তাহার পর ওমরাহ ও মন্সবদারগণ অপরূপ সজ্জা করিয়া মসজিদে গমন করে। কিন্তু আর এ স্থানে দাঁড়াইয়া কি হইবে? চল, আমরা দুর্গের ভিতর যাইয়া রাজবাটী দেখি।

 দূর হইতেই রক্তবর্ণ উন্নত দুগ-প্রাচীরের অপরূপ সৌন্দর্য দেখিয়া নরেন্দ্রনাথ চমৎকৃত হইলেন। সেই সময়ে ভারতবর্ষে যে দেশের যে লোক আসিয়াছেন, তিনি দিল্লীর দুর্গ ও রাজবাটীর শ্বেতপ্রস্তর নির্মিত মসজিদ,প্রাসাদ ও হর্ম্যাবলীকে জগতের মধ্যে অতুল্য বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। দুর্গ-প্রবেশের স্থানে একটি বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ, তার মধ্যে একজন হিন্দুরাজার শিবিরশ্রেণী রহিয়াছে, রাজা দুর্গের দ্বাররক্ষা করিতেছেন, অশ্বারোহী ও ওমরাহগণ সর্বদাই এদিক ওদিক যাতায়াত করিতেছেন এবং দুর্গের ভিতর হইতে সিপাহীগণ বাহিরে আসিতেছে, আবার ভিতরে যাইতেছে। বিদেশীয় বণিক্গণ দুর্গদ্বারে সমবেত হইতেছে এবং সহস্র সহস্র ইতর লোকও নদীর স্রোতের ন্যায় এদিক ওদিক ধাবিত হইতেছে।

 দেশে দুইটি প্রস্তরনির্মিত হস্তীর আকৃতি, তাহার উপর দুইটি মানুষ্যের প্রতিমূর্তি। নরেন্দ্র উৎসক হইয়া ‘এ কাহার প্রতিমূর্তি’ জিজ্ঞাসা করিলেন। গজপতি বলিলেন, “আপনি হিন্দু, আপনি জানেন না? ইহারা দুইজন রাজপুত বীরপুরুষ। চিতোরের জয়মল্ল ও পত্ত, সম্রাট আকবরের সহিত ভীষণ যুদ্ধ করিয়া সেই দুর্গ রক্ষা করিয়াছিলেন। পরে যখন আর পারিলেন না অধীনতা স্বীকার করিতে অস্বীকৃত হইয়া যুদ্ধে হত হলেন। আমার পিতামহ তিলকসিংহ সেই যুদ্ধে জীবনদান করিয়াছিলেন, পিতা তেজসিংহের নিকট বাল্যকালে সে অপূর্ব কাহিনী শুনিতাম। পত্তের মাতা ও বনিতা বীররমণী ছিলেন, -তাঁহারাও বীরত্ব প্রকাশ করিয়া হত হয়েন। তাঁহাদিগের কীর্তি চিরস্মরণীয় কাবার জন্য সম্রাট আকবর এই প্রতিমূর্তি এই স্থানে স্থাপন করিয়াছেন। পরে গর্বে গজপতি বলিলেন, “কিন্তু রাজপুত রাজদিগের কীর্তি চিরস্মরণীয় করিবার জন্য প্রতিমূর্তির আবশ্যক নাই, যতদিন বীরত্বের গৌরব থাকিবে, রাজপূত নাম কেহ বিস্মৃত হইবে না,

৩৮