পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

রাজপুতানার প্রত্যেক পর্বতশিখরে রাজপুতের বীরনাম খোদিত আছে, ভারতবর্ষের প্রত্যেক বেগবতী নদীতরঙ্গে রাজপুতের বীরনাম শব্দিত হইতেছে।”

 প্রশস্ত পথ অতিবাহন করিয়া দুইজনে দুর্গের ভিতর প্রবেশ করিলেন। পথের দুই ধারে অট্টালিকা, তাহার উপর রাজকর্মচারিগণ রাজকার্য করিতেছেন। দুর্গের দ্বারের বাহিরে যেরূপ হিন্দুরাজগণ দ্বাররক্ষা করিতেন, ভিতরে এই পথেয় উপর মন্সবদার ও ওমরাহগণ সেইরূপ দ্বাররক্ষা করিতেন।

 দুর্গের ভিতর উভয়ে বড় বড় কারখানা দেখিতে পাইলেন। রাজপরিবারের যে সমুদয় বিচিত্রদ্রব্য আবশ্যক হইত, ঐ স্থানে তাহা প্রস্তুত হইত। এক স্থানে রেশমকার্যের কারখানা, অন্য স্থান স্বর্ণকারদিগের, অপর স্থান চিত্রকরদিগের। ছুতার, দরজী, চর্ম-ব্যবসায়ী, বস্তুব্যবসায়ী প্রভৃতি সকল প্রকার লোকের কারখানা ছিল। দেশে যত উৎকৃষ্ট কারিগর ছিল, তাহারা প্রত্যহ প্রাতঃকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত কার্য করিত ও মাসিক বেতন পাইত।

 সে সমস্ত কারখানা পশ্চাতে রাখিয়া উভয়ে ভিতরে যাইতে লাগিলেন। অনেক সমারোহের মধ্য দিয়া, অনেক বিস্ময়কর হর্ম্য-ও প্রাসাদের পাশ দিয়া যাইয়া অবশেষে জগদ্বিখ্যাত মর্মরপ্রাসাদ, “দেওয়ান-ই খাস” দেখিতে পাইলেন। প্রাসাদের ছাদ সুবর্ণ দ্বারা মণ্ডিত ও রৌদ্র-তাপে ঝলমল করিতেছে। প্রাসাদের ভিতরে সুবর্ণ ও হীরকখচিত দিবালোকে-প্রতিঘাতী রত্ন-বিনিন্দিত রাজ-সিংহাসনের উপর সম্রাট শাজাহান উপবেশন করিয়া রহিয়াছেন, তাঁহার গম্ভীর ও প্রশান্ত মুখমণ্ডল এখনও পীড়ার চিহ্ন অংকিত রহিয়াছে; তিনি এখন সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেন নাই। দক্ষিণপাশে জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা বসিয়া রহিয়াছেন, তাহার ললাট ও বদনমণ্ডল সুন্দর ও প্রশন্ত, কিন্তু মুখে দুর্দমনীয় দর্প ও অভিমান বিরাজ করিতেছে। বামদিকে পৌত্র সুলতান সোলাইমান দণ্ডায়মান হইয়া রহিয়াছেন; বয়স পঞ্চবিংশতি বর্ষ হইবে, অবয়ব ও আকৃতি সুন্দর ও উন্নত। পশ্চাতে খোজাগণ ময়ূরপুচ্ছ-বিনির্মিত চামর হেলাইতেছে। তলায় চারিদিকে রৌপ্য-নির্মিত রেল আছে, রেলের বাহিরে রাজা, ওমরাহ, মন্সবদার, দূত, সেনাপতি ও ভারতর্ষের প্রধান প্রধান লোক উচিত বেশভূষায় ভূষিত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে ভূমির দিকে চাহিয়া দণ্ডায়মান হইয়া রহিয়াছেন। সম্মুখস্থ সমভূমি লোকে পরিপূর্ণ কি ধনী, কি নির্ধন, কি উচ্চ, কি নীচ, সেস্থানে যাইয়া রাজাকে দর্শন করিবার অধিকার সকলেরই আছে? সেই অপূর্ব প্রাসাদে যথাই লিখিত রহিয়াছে,—“যদি পৃথিবীতে স্বর্গ থাকে, তবে এই স্বর্গ, এই —এই স্বর্গ।”

 সম্রাটের সম্মুখে প্রথমে সুন্দর আরবদেশীয় অশ্ব প্রদর্শিত হইল। পরে বৃহৎকায়

৩৯