পাতা:মাধবীকঙ্কণ - রমেশচন্দ্র দত্ত.pdf/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

পরিপূর্ণ হইয়াছে, যিনি মোগল সিংহাসনে স্তম্ভস্বরূপ, যিনি মোগলকুলের কুলতিলকস্বরূপ, তাঁহার জন্য যুদ্ধ করিব। আমি আপনার সম্মুখে আপনার সুখ্যাতি করিতে চাহি না, কিন্তু যখন আমি আপনাকে দেখি, আমার যথার্থই বোধ হয় যেন আপনার উদার ললাটে ‘সম্রাট’ শব্দ খোদিত রহিয়াছে, আপনার বিশাল বক্ষস্থল ও দীর্ঘ বাহতে যোদ্ধা শব্দ অঙ্কিত রহিয়াছে। আমার জীবন ধন্য যে এই বীরপুরুষের কার্য-সাধনে আমি লিপ্ত হইয়াছি। এই বলিয়া আওরংজীব সুবর্ণপত্রে আর একবার মদিরায় পরিপূর্ণ করিলেন।

 মোরাদ। আওরংজীব, আমি, যথার্থই আপনার বাক্যে পরিতুষ্ট হইলাম। কাল যুদ্ধ হইবে, সৈন্য সকল প্রস্তুত আছে?

 আওরংজীব। আমি তিন-চার দিন হইতেই প্রস্তুত আছি কিন্তু যুদ্ধব্যবসায়ে আমি এখনও অপরিপক্ব, একাকী সাহস হয় না। আপনি নিকটে থাকিলে আমার যেন বোধ হয় আমি পর্বত-পার্শ্বে নিরাপদে আছি, আমার সাহস দ্বিগুণ হয়।

 মোরাদ এরূপ আত্মাভিমানী ছিলেন যে, প্রবঞ্চনা এবং চাটুবাক্যও তাহার সত্য বলিয়া জ্ঞান হইত। বিশেষতঃ এক্ষণে অধিক মদিরা সেবনে কিয়ৎপরিমাণে জ্ঞানশূন্য হইয়াছিলেন? আওরংজীবের প্রশংসাবাক্যে সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন,—"ভ্রাতঃ! আপনিও কালে রণপণ্ডিত হইবেন, এক্ষণে কিছুদিন আমার উপর নির্ভর করুন। আর আমি—আমি জগতে কাহারও উপর নির্ভর করি না, কেবল আমার সাহস ও এই অসির উপর ভরসা করি।”—এই বলিয়া মোরাদ অসি নিষ্কাষিত করিলেন, দীপালোকে অসি ঝকঝক্ করিয়া উঠিল। পুনরায় অসি কোষে রাখিতে গেলেন, কিন্তু অতিশয় মদিরা সেবনে দৃষ্টি স্থির ছিল না, অসি মৃত্তিকায় পড়িয়া গেল। আওরংজীব হাস্য সংবরণ করিয়া আর এক পাত্র মদিরা দিলেন, মোরাদ তাহাও শেষ করিলেন।

 আওরংজীব বলিলেন,—"ভ্রাতঃ। তবে বিদায় হই, রণক্ষেত্রে আবার আপনার দর্শন পাইব।”

 মোরাদ। যাও, আওরংজীব, যাও, আমি আপনার উপর বড়ই পরিতুষ্ট হইলাম, আইস আলিঙ্গন করি।

 মোরাদ আলিঙ্গন করিতে উঠিলেন, কিন্তু অধিক মদিরা সেবন বশতঃ ভূমিতে ঢলিয়া পড়িলেন।

 আওরংজীবের মুখের ভাব তখন পরিবর্তিত হইল, ভ্রাতাকে যে সহাস্য মুখ দেখাইয়াছিলেন, এক্ষণে তাহা পরিবর্তিত হইল। মুখ গম্ভীর ভাব ধারণ করিল, ললাটে দুই তিনটি ভীষণ রেখা অঙ্কিত হইল; নিঃশব্দে সেই শিবির মধ্যে পদসঞ্চার করিতে লাগিলেন; মধ্যে মধ্যে এক-এবার হঠাৎ দণ্ডায়মান হয়েন, স্থিরদৃষ্টিতে এক-একবার

৪৭